বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে ‘অদ্দান’ উপত্যকাটি, সেখানেই ছিল ‘গিফার’ গোত্রের বসতি। মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলা ওখান দিয়ে সিরিয়া যাতায়াত করত। এসব কাফিলার নিরাপত্তার বিনিময়ে যে সামান্য অর্থ লাভ করতো তা দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। ডাকাতি, রাহাজানিও ছিল তাদের পেশা। যখন কোন বাণিজ্য কাফিলা তাদের দাবী অনুযায়ী খাদ্যসামগ্রী বা অর্থ আদায় করত না তখন তারা লুটতরাজ চালাতো।
জুনদুন ইবন জুনাদাহ, আবু যার নামেই যিনি পরিচিত- তিনিও ছিলেন এ কবীলারই সন্তান। বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহিলী যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তাঁর পেশাও ছিল রাহাজানি। ‘গিফার’ গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনে ঘটে গেল এক বিপ্লব। তাঁর গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া যে সকল মূর্তির পূজা করত, তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। সমগ্র আরব বিশ্বে সে সময় যে ধর্মীয় অনাচার, অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের সয়লাব চলছিল তা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি অধীরভাবে অপেক্ষা করতে থাকেন এমন একজন নবীর, যিনি মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাদের নিয়ে আসবেন।
তিনি রাহাজানি পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যখন সমগ্র আরব দেশ গুমরাহীর অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। হযরত আবু মা’শার বলেনঃ ‘আবু যার জাহিলী যুগেই মুওয়াহহিদ বা একত্ববাদী ছিলেন। এক আল্লাহ ছাড়া কাকেও তিনি উপাস্য বলে বিশ্বাস করতেন না, অন্য কোন মূর্তি বা দেবদেবীর পূজাও করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ও আল্লাহর ইবাদাত মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। এ কারণে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. আবির্ভাবের সংবাদ তাঁকে দিয়েছিল, বলেছিলঃ
‘‘আবু যার, তোমার মত মক্কার এক ব্যক্তি ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে থাকেন।’’
তিনি কেবল মুখে মুখেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন না, সেই জাহিলী যুগে নামাযও আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাতের তিন বছর পূর্ব থেকেই নামায আদায় করতাম।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাকে উদ্দেশ্য করে?’ বললেনঃ ‘আল্লাহকে।’ আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কোন দিকে মুখ করে?’ বলেছিলেনঃ ‘যে দিকে আল্লাহ ইচ্ছা করতেন।’
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটিও বেশ চমকপ্রদ। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তাঁর গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন, মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি তাঁর ভাই আনিসকে ডেকে বললেনঃ ‘তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তাঁর কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তাঁর মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে।’
আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যার খবর পেয়ে তখুনি ছটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানা কথা তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। আনিস বললেনঃ
– ‘কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটিকে দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহবান জানাচ্ছেন। আর এমন সব কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হলো না।’
– ‘মানুষ তাঁর সম্পর্কে কী বলাবলি করে?’
– ‘কেউ বলে তিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি।’
– ‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না, আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তাঁর অবস্থা দেখে আসতে পারি?’
– ‘নিশ্চয়ই। তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।’
পরদিন প্রত্যুষে আবু যার চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সংগে নিলেন কিছু পাথেয় ও এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শঙ্কিত, ভীতচকিত। না জানি কেউ জেনে ফেলে তাঁর উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় তিনি পৌঁছলেন মক্কায়। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তাঁর জানা নেই এ জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মাদের সা. বন্ধু না শত্রু।
দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি মুসাফির। ডাকলে, ‘আসুন আমার বাড়ীতে।’ আবু যার গেলেন তাঁর সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন। সকাল বেলা পানির মশক ও খাবারের পুটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মসজিদে। তবে দু’জনের একজনও একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।
পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সংগে পরিচয় হলো না। আজও তিনি মাসজিদেই শুয়ে পড়লেন। আজও আলী রা. আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেনঃ ব্যাপার কি, লোকটি আজও তাঁর গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকে আবার সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এ রাতটিও সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এলো। আলী রা. আজ বললেনঃ
– ‘বলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন?’
তিনি বললেন, ‘আপনি যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন আমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের দিকে আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি।’ আলী রা. অঙ্গীকার করলেন।
আবু যার বললেনঃ ‘আমি অনেক দূর থেকে মক্কায় এসেছি, নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন তার কিছু শুনতে।
আলীর রা. মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী।’ একথা বলে তিনি নানাভাবে নবীর সা. পরিচয় দিলেন। তিনি আরও বললেন, ‘‘সকালে আমি যেখানে যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোন কিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলবো, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন।
প্রিয় নবীর দর্শন লাভ ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবু যার সারাটি রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সংগে করে আলী রা. চললেন রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীর দিকে। আবু যার তাঁর পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে তাঁরা পৌঁছলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। আবু যার সালাম করলেন।
– ‘আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল সা. জবাব দিলেন,
– ‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’
এভাবে আবু যার সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূলুল্লাহকে সা. সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত ও প্রচারিত হয়।
রাসূল সা. আবু যারকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াতও তিলাওয়াত করে শুনালেন। সেখানে বসেই আবু যার কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করে নতুন দ্বীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন।
এর পরের ঘটনা আবু যার এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. সংগে আমি মক্কায় অবস্থান করতে লাগলাম। তিনি আমাকে ইসলামের নানান বিষয় শিক্ষা দিলেন, কুরআনের কিছু আয়াত পাঠের প্রশিক্ষণও দিলেন। আমাকে বললেনঃ ‘মক্কায় কারও কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করবে না। কেউ জানতে পেলে আমি তোমার জীবনের আশংকা করছি।
বললাম, ‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ করে বলছি, আমি মক্কা ছেড়ে যাবনা, যতক্ষণ না মাসজিদে গিয়ে কুরাইশদের মাঝে প্রকাশ্যে সত্যের দাওয়াত দিচ্ছি।’ রাসূল সা. চুপ হয়ে গেলেন।
আমি মাসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গল্প গুজব করছে। আমি তাদের মাঝখানে হাজির হয়ে যতদূর সমস্ত উচ্চকণ্ঠে সম্বোধন করে বললাম, ‘‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল।
আমার কথাগুলি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তারা ভীত-চকিত হয়ে পড়লো। একযোগে তারা লাফিয়ে উঠে বললঃ এই ধর্মত্যাগীকে ধর। তারা দৌড়ে এসে আমাকে বেদম প্রহার শুরু করলো। রাসূলের সা. চাচা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব দেখে চিনতে পারলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচানের জন্য তিনি আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর তাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা নিপাত যাও! গিফারী গোত্রের এবং তোমাদের বাণিজ্য কাফিলর গমনাগমন পথের লোককে হত্যা করছো? তারা আমাকে ছেড়ে দিল।
একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না?’ বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে আমি প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।’ তিনি বললেন, ‘‘তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যাও। যা দেখে গেলে এবং যা কিছু শুনে গেলে তাদের অবহিত করবে, তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাবে। হতে পারে আল্লাহ তোমার দ্বারা তাদের উপকৃত করবেন এবং তোমাকে প্রতিদান দেবেন। যখন তুমি জানবে, আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিচ্ছি, আমার কাছে চলে আসবে।
আমি ফিরে এলাম আমার গোত্রীয় লোকদের আবাসভূমিতে। আমার ভাই আনিস এলো আমার সংগে সাক্ষাৎ করতে। সে জিজ্ঞেস করলোঃ ‘কি করলেন?’ বললাম, ‘ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হয়েছি।’ তক্ষুণি আল্লাহ তাঁর অন্তর-দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলেন। সে বলল, ‘আপনার দ্বীন প্রত্যাখ্যান করার ইচ্ছা আমার নেই। আমি ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বাসী হলাম।’ তারপর আমরা দু’ভাই একত্রে আমাদের মায়ের কাছে গিয়ে তাঁকেও ইসলামের দাওয়াত দিলাম।’ ‘তোমাদের দু’ভাইয়ের দ্বীনের প্রতি আমার কোন অনীহা নেই’- একথা বলে তিনিও ইসলাম কবুল করার ঘোষণা দিলেন।
সেইদিন থেকে এই বিশ্বাসী পরিবার নিরলসভাবে গিফার গোত্রের মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকে। এ কাজে কখনও তারা হতাশ হননি, কখনও মনোবল হারাননি। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টায় এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে নামাযের জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এক দল লোক বলে, আমরা আমাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবো। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় এলো আমরা ইসলাম গ্রহণ করবো। রাসূলের সা. মদীনায় হিজরতের পর তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ গিফার গোত্র সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘‘গিফার গোত্র- আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেছেন, আর আসলাম গোত্র- আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছেন।
আবু যার মক্কা ফিরে এসে গোত্রীয় লোকদের সাথে মরুভূমিতে অবস্থান করতে থাকেন। একে একে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি মদীনায় এলেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অবলম্বন করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে আবেদন করলেন তাঁর খিদমতের সুযোগ দানের জন্য। তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করা হল। মদীনায় অবস্থানকালে সবটুকু সময় তিনি অতিবাহিত করতেন রাসূলুল্লাহর সা. সেবায়। এটাই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয় কাজ। তিনি নিজেই বলতেনঃ
‘‘রাসূলুল্লাহর সা. খিদমত করতাম, আর অবসর সময়ে মসজিদে এসে বিশ্রাম নিতাম।’’
ইবন ইসহাক বলেনঃ আবু যার হিজরাত করে মদীনায় এলে রাসুল সা. মুনজির ইবন ’আমর ও আবু যারের মধ্যে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মত হল, আবু যার মীরাসের আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদীনায় হিজরাত করে এসেছিলেন। সুতরাং ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপনের নিয়মটি রহিত হয়ে গিয়েছিল।
রাসূলুল্লাহর সা. সংগে তাঁর যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। তবে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণের একটি ঘটনা আল্লামা ইবন হাজার আসকিলানী- ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতঃস্তত ভাব প্রকাশ করতে লাগলো। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, অমুক আসেনি।
জবাবে তিনি বলতেন, ‘যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয় তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। অন্যথায় আল্লাহ তাকে তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার দিক থেকে তোমাদের নিরাপদ করেছেন।’ এক সময় আবু যারের নামটি উল্লেখ করে বলা হল ‘সেও পিঠটান দিয়েছে।’ প্রকৃত ঘটনা হল, তাঁর উটটি ছিল মন্থরগতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানযিলে রাসূলুল্লাহ সা. সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাঁকে দেখে বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, রাস্তা দিয়ে কে যেন একজন আসছে।’ তিনি বললেনঃ ‘আবু যারই হবে।’ লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পার। বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, এতো আবু যারই।’ তিনি বললেনঃ
‘আল্লাহ আবু যারের ওপর রহম করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামাতের দিন একাই উঠবে।’ (তারীখুল ইসলামঃ আল্লামা জাহাবী, ৩য় খণ্ড) রাসূলুল্লাহর সা. ভবিষ্যদ্বানীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
হযরত আবু যার ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়া বিরাগী ও নির্জনতা-প্রিয় স্বভাবের। এ কারণে রাসূলে পাক সা. তাঁর লকব দিয়েছিলেন- ‘মসিহুল ইসলাম’। রাসূলের সা. ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনও প্রশমিত হয়নি। এ কারণে হযরত আবু বকরের ইনতিকালে তাঁর ভগ্ন হৃদয় আরও চুরমার হয়ে যায়। তাঁর দৃষ্টিতে তখন মদীনার সুশোভিত উদ্যানটি পত্র-পল্লবহীন বলে প্রতিভাত হয়। তিনি মদীনা ত্যাগ করে শামে (সিরিয়া) প্রবাসী হন।
আবু বকর ও উমারের রা. খিলাফতকাল পর্যন্ত ইসলামের সহজ ও সরল জীবন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। বিজয় ও ইসলামী খিলাফতের বিস্তৃতির সাথে যখন ধন ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য দেখা দেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই চাকচিক্য ও জৌলুস সে স্থান দখল করে নেয়। হযরত উসমানের রা. যুগেই বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে শানশওকাতের সূচনা হয়। সাধারণ জনজীবনে এর কিছুটা প্রভাব পড়ে। তাদের মধ্যে নবীর সা. আমলের সরলতার পরিবর্তে ভোগ ও বিলাসিতার ছাপ ফুটে ওঠে।
আবু যার মানুষের কাছে নবীর সা. আমলের সেই সহজ সরল আড়ম্বরহীন জীবনধারার অনুসরণ আশা করতেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল সকলেই তাঁর মন ধন-দৌলতের প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হউক। তাঁর আল্লাহ নির্ভর বিশ্বাস ও মতবাদে আগামীকালের জন্য কোন কিছুই আজ সঞ্চয় করা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, অন্যকে অভুক্ত ও উলংগ রেখে সম্পদ পুঞ্জিভূত করার কোন অধিকার কোন মুসলিমের নেই।
হযরত মুআবিয়া রা. ও অন্যান্য আমীরগণ মনে করতেন সম্পদশালী লোকদের ওপর আল্লাহ যে যাকাত ফরয করেছেন তা সঠিকভাবে আদায় করার পর অতিরিক্ত অর্থ জমা করার ইখতিয়ার প্রতিটি মুসলিমের আছে। এ মতপার্থক্য বৃদ্ধি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঝগড়া ও বচসার রূপ লাভ করে। আবু যার অত্যন্ত নির্ভীকভাবে ঐ সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের লক্ষ্যবস্তু বলে গণ্য করতে থাকেন।
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
– ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জিভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।’ (আত্ তাওবাহঃ ৩৪)
এ আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের আলোচনা এসেছে। এ কারণে আমীর মুআবিয়ার বক্তব্য ছিল, এ আয়াতের সম্পর্ক ঐ সব বিধর্মীদের সাথে। আর আবু যার মনে করেন, আয়াতটির উদ্দেশ্য মুসলিম অমুসলিম সকলেই। দ্বিতীয়তঃ আবু যার আল্লাহর পথে ব্যয় না করার অর্থ এই বুঝাতেন যে, সে নিজের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দেয় না। আর আমীর মুআবিয়ার ধারণা ছিল এটা কেবল যাকাতের সাথে সম্পৃক্ত।
এভাবে হযরত আবু যার স্বীয় চিন্তা-দর্শন ও মত অনুযায়ী অত্যন্ত কঠোরভাবে সমালোচনা আরম্ভ করেন। হযরত মুআবিয়া রা. মনে করেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে শামে যে কোন সময় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তিনি খলীফা উসমানকে রা. নাজুক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং অনুরোধ করলেন তিনি যেন আবয যারকে মদীনায় তলব করেন। হযরত উসমান তাঁকে মদীনায় ডেকে পাঠান।
একদিন আবযু যার বসে আছেন। তাঁরই সামনে খলীফা ’উসমান রা. কা’বকে রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ পুঞ্জিভুত করে, তার যাকাত দেয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয়ও করে- এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী ধারণা পোষণ করেন?’ কা’ব রা. বললেনঃ ‘এ ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো আশা পোষণ করা যায়।’ এ কথা শুনে আবু যার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কা’বের মাথার ওপর হাতে লাঠিটি তুলে ধরে বললেন, ‘ইয়াহুদী নারীর সন্তান, (কা’ব ইয়াহুদীর সন্তান ছিলেন) তুমি এর মর্ম কি বুঝবে। কিয়ামাতের দিন এমন ব্যক্তির অন্তরকেও বৃশ্চিক দংশন করবে।
হযরত উসমান শেষ পর্যন্ত আবু যারকে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে থাকুন, দুগ্ধবতী উটনী প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আপনার দরজায় হাজির হবে।’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘তোমার এ দুনিয়ার কোন প্রয়োজন আমার নেই।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। অবশেষে হযরত উসমান তাঁকে অনুরোধ জানালেন, মদীনা থেকে বহুদূরে মরুভূমির মাঝখানে ‘রাবজা’ নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করার জন্য। অনেকে মতে তিনি স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
লোকালয়ে থেকে বহুদূরে নির্জন প্রান্তরে ভোগ বিলাসী জীবনকে পরিহার করে আল্লাহর রাসূলের সা. পরকাল-আসক্ত জীবনকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে আমরণ সেখানে পড়ে থাকেন। হযরত আবু যারের ওফাতের কাহিনীটাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং চমকপ্রদও বটে। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনের তিনি ‘রাবজা’র মরুভূমিতে ইনতিকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ
‘‘আবু যারের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়লো, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছো কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার ও আপনার ব্যবহৃত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল সা.-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘যে মুসলিমের দুই অথবা তিনটি সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য তাই-ই যথেষ্ট।
তিনি কতিপয় লোকের সামনে, তার মধ্যে আমিও ছিলাম, বলেছিলেনঃ তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণ সময়ে মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে।’ আমি ছাড়া সেই লোকগুলির সকলেই লোকালয়ে ইন্তিকাল করেছে। এখন একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সে ব্যক্তি আমি। আমি কসম করে বলছি, আমি মিথ্যা বলছিনা এবং যিনি এ কথা বলেছিলেন তিনিও কোন মিথ্যা বলেননি।
তুমি রাস্তার দিকে চেয়ে দেখ গায়েবী সাহায্য অবশ্যই এসে যাচ্ছে।’ আমি বললামঃ ‘এখন তো হাজীদেরও প্রত্যাবর্তন শেষ হয়েছে, রাস্তায়ও লোক চলাচল বন্ধ।’ তিনি বললেন, ‘না’ তুমি যেয়ে দেখ।’ সুতরাং এক দিকে গৌড়ে গিয়ে টিলার ওপর উঠে দূরে তাকিয়ে দেখছিলাম, অপর দিকে ছুটে এসে তাঁর শুশ্রুষা করছিলাম। এরূপ ছুটাছুটি ও অনুসন্ধান চলছিল। এমন সময় দূরে কিছু আরোহী দৃষ্টিগোচর হলো। আমি তাদেরকে ইশারা করলে তারা দ্রুতগতিতে আমার নিকট এসে থেমে গেল।
আবু যার সম্পর্কে তারা প্রশ্ন করলো, ‘ইনি কে?’ বললামঃ ‘আবু যার।’ ‘রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী?’ বললামঃ ‘হাঁ।’ ‘মা বাবা কুরবান হউক’- একথা বলে তারা আবু যারের কাছে গেল। আবু যার প্রথমে তাদেরকে রাসূলের সা. ভবিষ্যৎ বাণী শানালেন। তারপর অসিয়ত করলেন, ‘যদি আমার নিকট অথবা আমার স্ত্রীর নিকট থেকে কাফনের পরিমাণ কাপড় পাওয়া যায় তাহলে তা দিয়েই আমাকে দাফন দেবে।’
তারপর তাদেরকে কসম দিলেন, যে ব্যক্তি সরকারের ক্ষুদ্রতম পদেও অধিষ্ঠিত সে যেন তাঁকে কাফন না পরায়। ঘটনাক্রমে এক আনসারী যুবক ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য সকলেই কোন না কোন সরকারী দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। আবু যার তাকেই কাফন পরাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কাফিলাটি ছিল ইয়ামনী। তারা কুফা থেকে আসছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.। এ কাফিলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যারের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাঁকে ‘রাবজার’ মরুভূমিতে দাফন করেন।
হযরত আবু যার থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট আটাশ। তন্মধ্যে বারোটি হাদীস মুত্তাফাক আলাইহি অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছে। দু’টি বুখারী ও সাতটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদের তুলনায় তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ তিনি সবসময় চুপচাপ থাকতেন, নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং মানুষের সাথে মেলামেশা কম করতেন। এ কারণে তাঁর জ্ঞানের তেমন প্রচার হয়নি। অথচ হযরত আনাস ইবন মালিক, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস প্রমুখের ন্যায় বিদ্বান সাহাবীগণ তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। ইবন আসাকির তাঁর ‘তারীখে দিমাশক’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
হযরত আীকে রা. আবু যারের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘এমন জ্ঞান তিনি লাভ করেছেন যা মানুষ অর্জন করতে অক্ষম। তারপর সে জ্ঞান আগুনে সেক দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে কিন্ত তা থেকে কোন খাদ বের হয়নি।’ এ মহান সাধক ও দুনিয়া নিরাসক্ত সাহাবী সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘আসমানের নীচে ও যমীনের ওপরে আবু যার সর্বাধিক সত্যবাদী ব্যক্তি।
হযরত উসমানের খিলাফতকালে আবু যার একবার হজ্জে গেলেন। এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘উসমান মিনায় অবস্থানকালে চার রাকা’আত নামায আদায় করেছেন (অর্থাৎ কসর করেননি)।’ বিষয়টি তাঁর মনঃপুত হলো না। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা., আবু বকর ও উমারের পেছনে আমি নামায আদায় করেছি। তাঁরা সকলে দু’ রাকা’আত পড়েছেন।’ একথা বলার পর তিনি নিজেই ইমামতি করলেন এবং চার রাকা’আতই আদায় করলেন।
লোকেরা বলল, ‘আপনিইতো আমীরুল মু’মিনীনের সমালোচনা করলেন আর এখন নিজেই চার রাকাআত আদায় করলেন।’ তিনি বললেন, ‘‘মতভেদ খুবই খারাপ বিষয়। রাসূল সা. বলেছেন, ‘আমার পরে যারা আমীর হবে তাদের অপমান করবেনা। যে ব্যক্তি তাদের অপমান করার ইচ্ছা করবে সে ইসলামের সুদৃঢ় রজ্জু স্বীয় কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলবে এবং নিজের জন্য তাওবার দরজা বন্ধ করে দেবে।’’ (মুসনাদে আহমাদ, ৫/১৬৫)
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর যখনই পবিত্র নামটি তাঁর জিহ্বায় এসে যেত, চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতো। আহনাফ বিন কায়েস বর্ণনা করে, ‘‘আমি একবার বাইতুল মাকদাসে এক ব্যক্তিকে একের পর এক সাজদাহ করতে দেখলাম।
এতে আমার অন্তরে এক বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। আমি যখন দ্বিতীয়বার তার কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কি বলতে পারেন আমি জোড় না বেজোড় নামায আদায় করেছি?’ তিনি বললেন, ‘আমি না জানলেও আল্লাহ নিশ্চয়ই জানেন।’ তারপর বললেনঃ ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম আমাকে বলেছেন’ এতটুকু বলেই তিনি কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম আমাকে বলেছেন।’ এবারও কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে গেল।
অবশেষে নিজেকে সম্বরণ করে নিয়ে বললেনঃ ‘আমার বন্ধু আবুল কাসিম সা. বলেছেনঃ যে বান্দা আল্লাহকে একটি সাজদাহ করে, আল্লাহ তার একটি দরজা বৃদ্ধি করেন এবং তার একটি পাপ মোচন করে একটি নেকী লিপিবদ্ধ করেন।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কে?’ তিনি বললেনঃ ‘আবু যার- রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী।’’
একদিন এক ব্যক্তি আবু যারের নিকট এলো। সে তাঁর ঘরের চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো। গৃহস্থালীর কোন সামগ্রী দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, –
‘আবু যার, আপনার সামান-পত্র কোথায়? –
‘আখিরাতে আমার একটি বাড়ী আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দিই।’
একদা সিরিয়ার আমীর তাঁর নিকট তিনশ’ দীনার পাঠালেন। আর বলে পাঠালেন, এ দ্বারা আপনি আপনার প্রয়োজন পূর্ণ করুন। ‘শামের আমীর কি আমার থেকে অধিকতর নীচ কোন আল্লাহর বান্দাকে পেলনা?’- একথা বলে তিনি দীনারগুলি ফেরত পাঠালেন।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সালমান নবী পরিবারেরই একজন।’ এটি একজন সত্য-সন্ধানী ও আল্লাহকে পাওয়ার অভিলাষী এক ব্যক্তির জীবন কথা। তিনি হযরত সালমান আল-ফারেসী। সালমান আল-ফারেসীর যবানেই তাঁর সেই সত্য প্রাপ্তির চমকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেনঃ আমি তখন পারস্যের ইসফাহার অঞ্চলের একজন পারসী নওজোয়ান। আমার গ্রামটির নাম ‘জায়্যান’। বাবা ছিলেন গ্রামের দাহকান-সর্দার। সর্বাধিক ধনবান ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী।
জন্মের পর থেকেই আমি ছিলাম তাঁর কাছে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচে বেশি প্রিয়। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালবাসাও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কোন অমঙ্গলের আশংকায় তিনি আমাকে মেয়েদের মত ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন। আমার বাবা-মার মাজুসী ধর্মে আমি কঠোর সাধনা শুরু করলাম এবং আমাদের উপাস্য আগুনের তত্ত্বাবধায়কের পদটি খুব তাড়াতাড়ি অর্জন করলাম।
রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উপাসনার সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্বটি আমার ওপর অর্পিত হয়। আমার বাবা ছিলেন বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। তিনি নিজেই তা দেখাশুনা করতেন। তাতে আমাদের প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো। একদিন কোন কারণবশত তিনি বাড়িতে আটকে গেলেন, গ্রামের খামারটি দেখাশুনার জন্য যেতে পারলেন না।
আমাকে ডেকে তিনি বললেনঃ ‘বেটা, তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, বিশেষ কারণে আজ আমি খামারে যেতে পারছিনা। আজ বরং তুমি একটু সেখানে যাও এবং আমার তরফ থেকে সেখানকার কাজকর্ম তদারক কর।’ আমি খামারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে খৃষ্টানদের একটি গীর্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কিছু কথার আওয়ায আমার কানে ভেসে এলো। তারা তখন প্রার্থনা করছিলো। এ আওয়াযই আমাকে সচেতন করে তোলে।
দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে খৃষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞানই ছিল না। তাদের কথার আওয়ায শুনে তারা কি করছে তা দেখার জন্য আমি গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। গভীরভাবে তাদেরকে আমি নিরীক্ষণ করলাম। তাদের প্রার্থনা পদ্ধতি আমার খুবই ভালো লাগলো এবং আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললামঃ আমরা যে ধর্মের অনুসারী তা থেকে এ ধর্ম অতি উত্তম। আমি খামারে না গিয়ে সে দিনটি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিলাম। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ – এ ধর্মের মূল উৎস কোথায়? – শামে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। সারাদিন আমি কি কি করেছি, বাবা তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। বললামঃ ‘বাবা কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলাম তারা তাদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছে। তাদের ধর্মের যেসব ক্রিয়াকাণ্ড আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা আমার খুবই ভালো লেগেছে। বেলা ডোবা পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিয়েছি।’ আমার কথা শুনে বাবা শংকিত হয়ে পড়লেন।
তিনি বললেনঃ ‘বেটা, সে ধর্মে কোন কল্যাণ নেই, তোমার ও তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম তা থেকেও উত্তম।’ বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, কখনো তা নয়। তাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকেও উত্তম।’ আমার কথা শুনে বাবা ভীত হয়ে পড়লেন এবং আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারি বলে তিনি আশংকা করলেন। তাই আমার পায়ে বেড়ী লাগিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলেন। আমি সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সে সুযোগ এসে গেল। গোপনে খৃস্টানদের কাছে এই বলে সংবাদ পাঠালাম যে, শাম অভিমুখী কোন কাফিলা তাদের কাছে এলে তারা যেন আমাকে খবর দেয়।
কিছুদিনের মধ্যেই শাম অভিমুখী একটি কাফিলা তাদের কাছে এলো। তারা আমাকে সংবাদ দিল। আমি আমার বন্দীদশা তেকে পালিয়ে গোপনে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তারা আমাকে শামে পৌঁছে দিল। শামে পৌঁছে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ – এ ধর্মের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি কে? তারা বললোঃ বিশপ, গীর্জার পুরোহিত।
আমি তাঁর কাছে গেলাম। বললামঃ আমি খৃষ্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমার ইচ্ছা, আপনার সাহচর্যে থেকে আপনার খিদমত করা, আপনার নিকট থেকে শিক্ষালাভ ও আপনার সাথে প্রার্থনা করা। তিনি বললেনঃ ভেতরে এসো। আমি ভেতরে ঢুকে তার কাছে গেলাম এবং তার খিদমত শুরু করে দিলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি বুঝতে পারলাম লোকটি অসৎ।
কারণ সে তার সংগী সাথীদেরকে দান-খয়রাতের নির্দেশ দেয়, সওয়াব লাভের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে; কিন্তু যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য তার হাতে কিছু তুলে দেয়, তখন সে নিজেই তা আত্মসাত করে এবং নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে রাখে। গরীব মিসকীনদের সে কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত কলস স্বর্ণ পুঞ্জিভূত করে। তার এ চারিত্রিক অধপতন দেখে আমি তাকে ভীষণ ঘৃণা করতাম।
কিছু দিনের মধ্যেই লোকটি মারা গেল। এলাকার খৃষ্টান সম্প্রদায় তাকে দাফনের জন্য সমবেত হলো। তাদেরকে আমি বললামঃ তোমাদের এ বন্ধুটি খুবই অসৎ প্রকৃতির লোক ছিল। তোমাদের সে দান খয়রাতের নির্দেশ দিত এবং সেজন্য তোমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। কিন্তু তোমরা যখন তা তার হাতে তুলে দিতে সে সবই আত্মসাত করতো। গরীব-মিসকীনদের কিছুই দিত না। তারা জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি তা কেমন করে জানলে? বললামঃ তোমাদেরকে আমি তার পুঞ্জিভূত সম্পদের গোপন ভাণ্ডার দেখাচ্ছি।
তারা বললোঃ ঠিক আছে, তাই দেখাও। আমি তাদেরকে গোপন ভাণ্ডারটি দেখিয়ে দিলে তারা সেখান থেকে সাত কলস সোনা-চান্দি উদ্ধার করে। এ দেখে তারা বললোঃ – আল্লাহর কসম আমরা তাকে দাফন করবো না। তাকে তারা শুলিতে লটকিয়ে পাথর মেরে তার দেহ জর্জরিত করে দিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা অন্য এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করলো।
আমি তাঁরও সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এ লোকটি অপেক্ষা দুনিয়ার প্রতি অধিক উদাসীন, আখিরাতের প্রতি অধিক অনুরাগী ও রাতদিন ইবাদতের প্রতি বেশী নিষ্ঠাবান কোন লোক আমি এর আগে দেখিনি। আমি তাঁকে অত্যধিক ভালোবাসতাম। একটা দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে আমি কাটালাম।
যখন তাঁর মরণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমি তাঁকে বললামঃ – জনাব, আপনার মৃত্যুর পর কার সাহচর্যে কাটাবার উপদেশ দিচ্ছেন আমাকে? বললেনঃ বেটা আমি যে সত্যকে আঁকড়ে রেখেছিলাম, এখানে সে সত্যের ধারক আর কাউকে আমি জানিনা। তবে মাওসেলে এক ব্যক্তি আছে, নাম তাঁর অমুক, তিনি এ সত্যের এক বিন্দুও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করেননি।
তুমি তঁঅর সাহচর্য অবলম্বন করেঅ্ আমার সে বন্ধুটির মৃত্যুর পর মাওসেলে গিয়ে তাঁর বর্ণিত লোকটিকে আমি খুঁজে বের করি। আমি তাঁকে আমার সব কথা খুলে বলি। একথাও তাঁকে আমি বলি যে, অমুক ব্যক্তি তাঁর অন্তিম সময়ে আমাকে আপনার সাহচর্য অবলম্বনের কথা বলে গেছেন। আর তিনি আমাকে একথাও বলে গেছেন যে, তিনি যে সত্যের ওপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আপনি সে সত্যকেই গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছে থাক। আমি তাঁর কাছে থেকে গেলাম। তাঁর চালচলন আমার ভালোই লাগলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। তাঁর মরণ সময় নিকটবর্তী হলে আমি তাঁকে বললামঃ – জনাব, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আল্লাহর ফায়সালা আপনার কাছে এসে গেছে। আর আমার ব্যাপারটি তো আপনি অবগত আছেন।
এখন আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন? বললেনঃ বেটা, আমরা যে জিনিসের ওপর ছিলাম, তার ওপর অটল আছে এমন কাউকে তো আমি জানিনা। তবে ‘নাস্সিবীনে’ অমুক নামে এক ব্যক্তি আছেন, তুমি তাঁর সাথে মিলতে পার। তাঁকে কবর দেওয়ার পর আমি নাস্সিবীনের সেই লোকটির সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমার সমস্ত কাহিনী তাঁকে খুলে বললাম। তিনি আমাকে তাঁর কাছে থেকে যেতে বললেন। আমি থেকে গেলাম।
এ ব্যক্তিকেও পূর্ববর্তী দু’বন্ধুর মত নিষ্কলুষ চরিত্রের দেখতে পেলাম। আল্লাহ কি মহিমা, অল্পদিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। অন্তিম সময়ে তাঁকে আমি বললামঃ আমার সম্পর্কে আপনি মোটামুটি সব কথা জানেন। এখন আমাকে কার কাছে যেতে বলেন? তিনি বললেনঃ অমুন নামে ‘আম্মুরিয়াতে’ এক লোক আছেন, তুমি তাঁরই সুহবত অবলম্বন করবে। এছাড়া আমাদের এ সত্যের ওপর অবশিষ্ট আর কাউকে তো আমি জানিনা।
তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে আমি আমার সব কথা বললাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ আমার কাছে থাক। আল্লাহর কসম, তাঁর কাছে থেকে আমি দেখতে পেলাম তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের মত একই মত ও পথের অনুসারী। তাঁর কাছে থাকাকালেই আমি অনেকগুলি গরু ও ছাগলের অধিকারী হয়েছিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের যে পরিণতি দেখেছিলাম, সেই একই পরিণতি তাঁরও ভাগ্যে আমি দেখতে পেলাম। তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে আমি তাঁকে বললামঃ আমার অবস্থা তো আপনি ভালোই জানেন। এখন আমাকে কি করতে বলেন, কার কাছে যেতে পরামর্শ দেন? বললেনঃ বৎস! আমরা যে সত্যকে ধরে রেখেছিলাম, সে সত্যের ওপর ভূ-পৃষ্ঠে জন্য কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে বলে আমার জানা নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে একজন নবী আবির্ভূত হবেন।
তিনি ইবরাহীমের দ্বীন নতুনভাবে নিয়ে আসবেন। তিনি তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড় বড় কালো পাথরের যমীনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তাঁর থাকবে। তিনি হাদিয়ার জিনিস তো খাবেন; কিন্তু সাদকার জিনিস খাবেন না।
তাঁর দু’কাঁধের মাঝখানে নুওয়াতের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও। এরপর তিনি মারা গেলেন। আমি আরো কিছুদিন আম্মুরিয়াতে কাটালাম। একদিন সেখানে ‘কালব’ গোত্রের কিছু আরব ব্যবসায়ী এলো। আমি তাদেরকে বললামঃ আপনারা যদি আমাকে সংগে করে আরব দেশে নিয়ে যান, বিনিময়ে আমি আপনাদেরকে আমার এ গরু ছাগলগুলি দিয়ে দেব। তাঁরা বললেনঃ ঠিক আছে, আমরা তোমাকে সংগে করে নিয়ে যাব।
আমি তাঁদেরকে গুরু-ছাগলগুলি দিয়ে দিলাম। তাঁরা আমাকে সংগে নিয়ে চললেন। যখন আমরা মদীনা ও শামে’র মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী আল-কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন তাঁরা আমার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করে এক ইহুদীর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল। আমি তার দাসত্ব শুরু করে দিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বনী কুরাইজা গোত্রের তার এক চাচাতো ভাই আমাকে খরীদ করে এবং আমাকে ‘ইয়াসরিবে’ (মদীনা) নিয়ে আসে। এখানে আমি আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত সেই খেজুর গাছ দেখতে পেলাম এবং তিনি স্থানটির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী শহরটিকে চিনতে পারলাম।
এখানে আমি আমার মনিবের কাছে কাটাতে লাগলাম। নবী সা. তখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু দাস হিসাবে সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বা আলোচনা আমার কানে পৌঁছেনি। কিছুদিনের মধ্যে রাসূল সা. মক্কা থেকে হিজরাত করে ইয়াসরিবে এলেন। আমি তখন একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠে কি যেন কাজ করছিলাম, আমার মনিব গাছের নীচেই বসে ছিলো এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে তাকে বললোঃ আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাজরাজ গোত্র) ধ্বংস করুন।
কসম খোদার, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে। তার কথাগুলি আমার কানে যেতেই আমার গায়ে যেন জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার ভয় হলো, গাছের নীচে বসা আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে না যাই। তাড়াতাড়ি আমি গাছ থেকে নেমে এলাম এবং সেই লোকটিকে বললামঃ – তুমি কি বললে? কথাগুলি আমার কাছে আবার বলো তো। আমার কথা শুনে আমার মনিব রেগে ফেটে পড়লো এবং আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললোঃ – এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি? যাও, তুমি যা করছিলে তাই কর।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার সংগৃহীত খেজুর থেকে কিছু খেজুর নিয়ে রাসূল সা. যেখানে অবস্থান করছিলেন সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূলের সা. নিকট পৌঁছে তাঁকে বললামঃ – আমি শুনেছি আপনি একজন পূর্ণবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী-সাথী আছেন। এ সামান্য কিছু জিনিস সদকার উদ্দেশ্যে আমার কাছে জমা ছিল, আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় আপনারাই এগুলি পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। এ কথা বলে খেজুরগুলি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম।
তিনি সঙ্গীদের বললেনঃ তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজের হাতটি গুটিয়ে নিলেন, কিছুই খেলেন না। মনে মনে আমি বললামঃ এ হলো একটি। সেদিন আমি ফিরে এলাম। আমি আবারও কিছু খেজুর জমা করতে লাগলাম। রাসূল সা. কুবা থেকে মদীনায় এলেন। আমি একদিন খেজুরগুলি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললামঃ ‘আমি দেখেছি, আপনি সদকার জিনিস খাননা।
তাই এবার কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্যে।’ এবার তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের আহ্বান জানালেন তাঁরাও তাঁর সাথে খেলেন। আমি মনে মনে বললামঃ এ হলো দ্বিতীয়টি। তারপর অন্য একদিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে গেলাম। তিনি তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ গোরস্থানে তাঁর এক সঙ্গীকে সঙ্গীকে দাফন করছিলেন।
আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরণের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর আমি তাঁর পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলাম। আমি খুঁজতে লাগলাম, আমার সেই আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত নবুওয়াতের মোহরটি। রাসূলসা. আমাকে তাঁর পিঠের দিকে ঘন ঘন তাকাতে দেখে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন এবং আমি মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি তখন পরিস্কারভাবে তাঁকে চিনতে পারলাম এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে চুমুতে ভরে দিলাম ও কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম।
আমার এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ – তোমার খবর কি? আমি সব কাহিনী খুলে বললাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং আমার মুখ দিয়েই এ কাহিনীটা তাঁর সংগীদের শোনাতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে শোনালাম। তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন, খুবই আনন্দিত হলেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে সালমান রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ফলে তিনি খুবই মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকেন। সালমান বলেনঃ ‘একদিন রাসূল সা. আমাকে ডেকে বললেনঃ তুমি তোমার মনিবের সাথে মুকাতাবা (চুক্তি)কর।
আমি চুক্তি করলাম, তাকে আমি তিন শ’ খেজুরের চারা লাগিয়ে দেব এবং সেই সাথে চল্লিশ ‘উকিয়া স্বর্ণও দেব। আর বিনিময়ে আমি মুক্তি লাভ করবো। আমি রাসূলুল্লাহর সা. এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেনঃ তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারা সংগ্রহ হয়ে গেল। তারপর আমি রাসূলের সা. নির্দেশে গর্ত খুড়লাম। তিনি নিজেই একদিন আমার সাথে সেখানে গেলেন। আমি তঁঅর হাতে একটি করে চারা তুলে দিলাম, আর তিনি সেটা রোপন করলেন।
আল্লাহর কসম, তাঁর একটি চারাও মারা যায়নি। (ঐতিহাসিকরা বলছেন, সালামান রা. একটি মাত্র চারা রোপন করেছিলেন, আর সেটাই মারা যায়। বাকী সবগুলিই রাসূলসা. রোপন করেছিলেন এবং সবগুলিই বেঁচে যায়।।) এভাবে আমি আমার চুক্তির একাংশ পূরণ করলাম, বাকী থাকলো অর্থ। একদিন রাসূল সা. আমাকে ডেকে মুরগীর ডিমের মত দেখতে স্বর্ণজাতীয় কিছু পদার্থ আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাও, তোমার চুক্তি মুতাবিক পরিশোধ কর। আমি বললাম, এত কি তা পরিশোধ হবে? তিনি বরলেনঃ ‘ধর, আল্লাহ এতেই পরিশোধ করবেন।
আল্লাহর কস, আমরা ওজন করে দেখলাম তাতে চল্লিশ উকিয়াই আছে। এভাবে সালমান রা. তার চুক্তি পূরণ করে মুক্তিলাভ করেন। গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে হযরত সালমান রা. মুসলমানদের সাথে বসবাস করতে থঅকেন। তখন তঁঅর কোন ঘর-বাড়ী চিল না। রাসুলসা. অন্যান্য মুহাজিরদের মত প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদার রা. সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। গোলামীর কারণে হযরত সালমান রা. বদর ও উহুদ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি।
গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার পর খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয। এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পূর্ববর্তী দু’টি যুদ্ধে অনুপস্থিতির ক্ষতি পুষিয়ে নেন। সারা আরবের বিভিন্ন গোত্র কুরাইশদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে রাসূল সা. সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেন। হযরত সালমান বলেন, পারস্যে পরিখা খনন করে নগরের হিফাজত করা হয়। মদীনার অরক্ষিত দিকে পরিখা খনন করে নগরীর হিফাজত করা সমীচীন।
এ পরামর্শ রাসূলুল্লাহর সা. মনঃপূত হয়। মদীনার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে সুদীর্ঘ পরিখা খনন করে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করা হয়। রাসুল সা. নিজেও এই পরিখা বা খন্দক খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে এ অপূর্ব রণ-কৌশল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ২১/২২ দিন মদীনা অবরোধ করে বসে থাকার পর শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। খন্দকের পর যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে হযরত সালমান অংগ্রহণ করেছেন।
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর হযরত সালমান বেশ কিছুদিন মদনিায় অবস্থান করেন। সম্ভবতঃ হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতের শেষে অথবা হযরত ’উমারের খিলাফতের প্রথম দিকে তিনি ইরাকে এবং তাঁর দ্বীনী ভাই আবু দারদা রা. সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত উমারের যুগে ইরান বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুসিলম মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। জালুলু বিজয়েও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হযরত উমার রা. তঁঅকে মাদায়েনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। হযরত উসমানের খিলাফতাকলে ইনতিকাল করেন।
ইসলম গ্রহণের পর হযরত সালমানের জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয় রাসূলুল্লাহর সা. সুহবতে। এ কারণে তিনি ইলম ও মা’রেফাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। হযরত আলীকে রা. তাঁর ইল্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেনঃ ‘সালমান ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে লুকমান হাকীমের সমতুল্য।’ অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি বলেনঃ ‘ইলমে আউয়াল ও ইলমে আখের সকল ইলমের আলিম ছিলেন তিনি।’ ইলমে আখের অর্থ কুরআনের ইলম। আরবে তার কোন আত্মীয় ও খান্দান ছিল না, তাই রাসূল সা. তাঁকে আহলে বাইতের সদস্য বলে ঘোষণা করেন।
হযরত মুয়াজ বিন জাবাল, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম ও মুজতাহিদ সাহাবী, বলেনঃ চার ব্যক্তি থেকে ইলম হাসিল করবে। সেই চারজনের একজন সালমান। হযরত সালমান থেকে ষাটটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মুত্তাফাক আলাইহি, একটি মুসলিম ও তিনটি বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরী, আবুত তুফাইল, ইবন আব্বাস, আউস বিন মালিক ও ইবন আজযা রা. প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর ছাত্র ছিলেন।
হযরত সালমান সেইসব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ ‘রাসূল সা. যেদিন রাতে সালমানের সাথে নিভৃতে আলোচনা করতে বসতেন, আমরা তাঁর স্ত্রীরা ধারণা করতাম সালমান হযতো আজ আমাদের রাতের সান্নিধ্যটুকু কেড়ে নেবে।’ যুহুদ ও তাকওয়ার তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। ক্ষণিকের মুসাফির হিসেবে তিনি জীবন যাপন করেছেন। জীবনে কোন বাড়ী তৈরী করেননি।
কোথাও কোন প্রাচীর বা গাছের ছায়া পেলে সেখানেই শুয়ে যেতেন। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে ইজাযত চাইলো, তাঁকে একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার। তিনি নিষেধ করলেন। বার বার পীড়াপীড়িতে শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ঘর বানাবে? লোকটি বললোঃ এত ছোট যে, দাঁড়ালে মাথায় চাল বেঁধে যাবে এবং শুয়ে পড়লে দেয়ালে পা ঠেকে যাবে। এ কথায় তিনি রাজী হলেন। তাঁর জন্য একটি ঝুপড়ি ঘর তৈরী করা হয়।
হযরত হাসান রা. বলেনঃ ‘সালমান যখন পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা পেতেন, তিরিশ হাজার লোকের উপর প্রভুত্ব করতেন তখনও তাঁর একটি মাত্র ‘আবা’ ছিল। তার মধ্যে ভরে তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন। ঘুমানোর সময় আবাটির এক পাশ গায়ে দিতেন এবং অন্য পাশ বিছাতেন।’ হযরত সালমান রা. যখন অন্তিম রোগ শয্যায়, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. তাঁকে দেখতে যান। সালমান রা. কাঁদতে শুরু করলেন।
সা’দ বললেনঃ আবু আবদিল্লাহ, কাঁদছেন কেন? রাসুল সা. তো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাউজে কাওসারের নিকট তাঁর সাথে আপনি মিলিত হবেন। বললেনঃ আমি মরণ ভয়ে কাদঁছিনে। কান্নার কারণ হচ্ছে, রাসূল সা. আমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যেন একজন মুসাফিরের সাজ-সরঞ্জাম থেকে বেশি না হয়। অথচ আমার কাছে এতগুলি জিনিসপত্র জমা হয়ে গেছে। সা’দ বলেনঃ সেই জিনিসগুলি একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা ও একটি পনির পাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
হিজরাতের পূর্বে মক্কায় নবুওয়াতের সপ্তম বছর চলছে। রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবীরা তখন কুরাইশদের চরম বাড়াবাড়ির শিকার। ইসলামী দাওয়াতের কঠিন দায়িত্ব ও বোঝা পালন করতে গিয়ে পদে পদে তিনি নানা রকম দুঃখ বেদনা ও মুসীবতের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন সময় তাঁর জীবনে একটু খুশির আলোক আভা দেখা দিল। সুসংবাদ দানকারী খুশীর বার্তা নিয়ে এলো, ‘উম্মু আয়মন’ একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সেই সৌভাগ্যবান নবজাতক, যার ধরাপৃষ্ঠে আগমণ সংবাদে আল্লাহর রাসূল সা. এত উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তিনি উসামা ইবন যায়িদ।
শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে রাসূলুল্লাহর সা. এত উৎফুল্ল হওয়াতে সাহাবীরা কিন্তু বিস্মিত হননি। কারণ, রাসূলুল্লাহর সা. নিকট শিশুটির মাতা-পিতার স্থান সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। শিশুটির মা ‘বারাকা আল হাবাশিয়্য’- যিনি ‘উম্মু আয়মন’ নামে পরিচিত।
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার দাসী। তাঁর জীবনকালে এবং ওয়াফাতের পরও এ মহিলা রাসূলুল্লাহকে সা. প্রতিপালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. দুনিয়াতে চোখ মেলে তাঁকেই মা বলে বুঝতে শেখেন। অত্যন্ত গভীর ও অকৃত্রিমভাবে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ভালোবাসতেন। প্রায়ই তিনি বলতেনঃ ‘আমার মায়ের পর ইনিই আমার মা এবং আমার আহলদের অবশিষ্ট ব্যক্তি। এ সম্মানিত মহিলাই হচ্ছেন এ নবজাতকের গৌরবান্বিত মা।
শিশুটির পিতা হলেন রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহভাজন, ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্মপুত্র, বিশ্বস্ত সংগী, ইসলামের পর রাসূলুল্লাহর সা. সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি- যায়িদ ইবন হারিসা রা.।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মক্কার সমগ্র মুসলিম সমাজ শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে উৎফুল্ল হয়েছিল। শিশুর পিতাকে যেমন তারা উপাধি দিয়েছিল ‘হিববু রাসুলিল্লাহ’, তেমনি তারা তাকে উপাধি দিল ‘ইবনুল হিব্ব’ বা রাসূলুল্লাহর সা. প্রীতিভাজনের পুত্র। তাদের এ উপাধি দান কিন্তু যথার্থই হয়েছিল। রাসূল সা. তাকে এত অধিক ভালোবেসেছিলেন যে, তা দেখে বিশ্ববাসীর ঈর্ষা হয়।
উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. দৌহিত্র হাসান ইবন ফাতিমার সমবয়সী। হাসান ছিলেন তাঁর নানা রাসূলুল্লাহর সা. মত দারুণ সুন্দর। আর উসামা ছিলেন তাঁর হাবশী মা’র হাবশী মা’র মত কালো ও খাঁদা নাক বিশিষ্ট। কিন্তু রাসূল সা. তাদের দু’জনকে স্নেহ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে মোটেই কম বেশী করতেন না। তিনি উসামাকে বসাতেন এক উরুর ওপর এবং হাসানকে অন্য উরুর ওপর। তারপর দু’জনকে একসাথে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলতেনঃ ‘হে আল্লাহ, আমি তাদের দু’জনকে ভালোবাসি, তুমিও তাদের উভয়কে ভালোবাস।’
শিশু উসামার প্রতি রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা কত গভীর ও প্রবল ছিল তা বুঝা যায় একটি ঘটনা দ্বারা। শিশু উসামা একবার দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তার কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। রাসুল সা. প্রথমে হযরত আয়িশাকে রা. রক্ত মুছে দিতে বললেন। কিন্তু তাতে স্বস্তি পেলেন না। তিনি নিজেই উঠে গিয়ে রক্ত মুছে ক্ষতস্থানে চুমু দিতে লাগলেন এবং মিষ্টি মধুর ও দরদ মিশ্রিত কথা বলে তাকে শান্ত করতে লাগলেন।
শৈশবের মত যৌবনেও উসামা রাসূলুল্লাহর সা. ভালোবাসা লাভ করেন। একবার কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকীম ইবন হিযাম ইয়ামনের ‘যী ইয়াযিন’ বাদশার একখানা মূল্যবান চাদর ইয়ামন থেকে পঞ্চাশ দীনার দিয়ে খরীদ করেন। চাদরখানি তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. উপহার দিতে চাইলে তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
কারণ, হাকীম তখনও মুশরিক ছিলেন। তবে রাসূল সা. তাঁর নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে চাদরখানি খরিদ করেন। এক জুমআর দিন একবার মাত্র সে চাদরখানি রাসূল সা. পরেন। তারপর তিনি তা উসামার গায়ে পরিয়ে দেন। উসামা সে চাদরখানি প’রে তার সমবয়সী মুহাজির ও আনসার যুবকদের সাথে সকাল সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতেন।
যৌবনে উসামার মধ্যে এমন সব চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলী বিকশিত হলো যা সহজেই রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তীক্ষ্ণ মেধা, দুঃসাহস, বিচক্ষণতা, পূতঃপবিত্র চরিত্র এবং তাকওয়া ও পরহিযগারী ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উহুদ যুদ্ধের দিন উসামা তাঁর সমবয়সী আরো কতিপয় কিশোর সাহাবীর সাথে উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে। তাদের সবার ইচ্ছা জিহাদে অংশগ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে নির্বাচন করলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে অন্যদের ফিরিয়ে দিলেন। উসামা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাড়ীতে ফিরছেন। চোখ দু’টি তাঁর পানিতে টলমল। তাঁর ব্যথা, রাসূলুল্লাহর সা. পতাকাতলে জিহাদের সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন।
খন্দকের যুদ্ধ সমুপস্থিত। উসামাও হাজির। তাঁর সাথে আরো কয়েকজন কিশোর সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সা. সৈনিক বাছাই করছেন। উহুদের মত এবারো তাঁকে ছোট বলে বাদ দেওয়া না হয়, এজন্য পায়ের আাঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর আগ্রহ দেখে রাসূলুল্লাহর সা. অন্তর নরম হলো। তাকে নির্বাচন করলেন। তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে উসামা চললেন জিহাদে। তিনি তখন ১২/১৩ বছরের এক কিশোর।
কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে প্রথম পর্যায়ের অভিযান সমূহে তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। ‘হারকা’ অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। সাত অথবা আট হিজরীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। তখন তাঁর বয়স চৌদ্দ। কিন্ত তাঁর সীমাহীন যোগ্যতার কারণে রাসূল সা. তাঁকে অভিযানের নেতৃত্ব দান করেন।
এ অভিযানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ ‘রাসূল সা. আমাদেরকে ‘হারকা’র দিকে পাঠালেন। শত্রুরা পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করলো। আমি এক আনসারী সিপাহীর সাথে পলায়নরত এক সৈনিকের পিছু ধাওয়া করলাম। যখন সে আমাদের নাগালের মধ্যে এসে গেল, জোরে জোরে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে উঠলো। তার এ ঘোষণায় আনসারী হাত গুটিয়ে নিল; কিন্তু আমি বর্শা ছুড়ে তাকে গেঁথে ফেললাম। সে মারা গেল।
অভিযান থেকে ফেরার পর বিষয়টি রাসূলুল্লাহর সা. কর্ণগোচর হলো। তিনি আমাকে বললেনঃ উসামা, কালিমা তাইয়্যেবা পড়ার পর তুমি একটি লোককে হত্যা করেছ। আমি বললাম, প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে এমনটি করেছে। তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। একই কথা বার বার আওড়াতে লাগলেন। আমি তখন এত অনুতপ্ত হলাম যে, মনে মনে বললাম, ‘হায়! আজকের পূর্বে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা. তাঁকে বলেনঃ ‘তুমি তার অন্তর ফেঁড়ে দেখলে না কেন?’
হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে লাগলো। উসামা তখন রাসূলুল্লাহর সা. চাচা আব্বাস, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিসসহ মাত্র ছ’জন সাহাবীর সাথে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে অটল হয়ে রুখে দাঁড়ালেন। বীর বিশ্বাসীদের ক্ষুদ্র এই দলটির সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সা. সেদিন নিশ্চিত পরাজয়কে বিজয়ের রূপদান করেন এবং পলায়নরত মুসলিম বাহিনীকে মুশরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেন।
মক্কা নিজয়েও উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সংগী। রাসূলুল্লাহর সা সাথে একই বাহনে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে উসামা, বিলাল ও উসমান ইবন তালহা এ তিন ব্যক্তিই সেদিন কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এ চারজনের পরই কা’বার দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
উসামা তাঁর পিতা সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসার সাথে মুতা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন তার বয়স আঠারো বছরেরও কম। এ যুদ্ধে তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন পিতার শাহাদাত। তবে তিনি মুষড়ে পড়েননি। পিতার শাহাদাত বরণের পর যথাক্রমে জা’ফর ইবন আবী তালিব ও আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নেতৃত্বে বাহাদুরের মত লড়াই করেন।
যায়িদের মত এ সেনাপতিও শাহাদাত বরণ করলে তিনি সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে রোমান বাহিনীর পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করেন। মূতার প্রান্তরে পিতা যায়িদের মরদেহ আল্লাহর হাওয়ালা করে যে ঘোড়ার ওপর তিনি শহীদ হয়েছিলেন, তার ওপর সওয়াব হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।
একাদশ হিজরীতে রাসূল সা. রোমান বাহিনীর সাতে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বকর, ‘উমার, সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবী এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল সা. উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন। তখন তাঁর বয়স বিশের কাছাকাছি। রাসূল সা. গাযা উপত্যকার নিকটবর্তী ‘বালকা’ ও ‘দারুম আল কিলয়ার’ আশে পাশে সীমান্তে ছাউনি ফেলার নির্দেশ দিলেন।
বাহিনী যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। এদিকে রাসূল সা. পীড়িত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাহিনীসহ তিনি যাত্রাবিরতি করে মদীনার উপকণ্ঠে ‘জুরুফ’ নামক স্থানে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখতে আসতেন। উসামা বলেন ‘রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পেলে আমি দেখতে গেলাম। আরো অনেকে আমার সংগে ছিলেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, রাসূল সা. চুপ করে আছেন। রোগের প্রচণ্ডতায় তিনি কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি আসমানের দিকে হাত উঠালেন, তারপর আমার শরীরের ওপর হাত রাখলেন। আমি বুঝলাম, তিনি আমার জন্য দু’আ করছেন।’
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকাল হলো। খবর পেয়ে তিনি মদীনায় ছুটে এলেন এবং কাফন দাফনে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মরদেহ কবরে নামানোর সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন।
হযরত আবু বকর রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন। তিনি উসামাকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আনসারদের ছোট্ট একটি দল মনে করলেন এ মুহূর্তে বাহিনীর যাত্রা একটু বিলম্ব করা উচিত। এ ব্যাপারে খলীফার সাথে কথা বরার জন্য তাঁরা হযরত উমারকে রা. অনুরোধ করলেন। তাঁরা উমারকে এ কথাও বললেন, যদি তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে অন্ততঃ তাঁকে অনুরোধ করবেন, উসামা থেকে একজন অধিক বয়সের লোককে যেন আমাদের সেনাপতি নিয়োগ করে।
হযরত আবু বকর বসে ছিলেন। হযরত ’উমারের রা. মুখে আনসারদের বক্তব্য শোনার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফারুকে আযমের দাড়ি মুট করে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেনঃ ‘ওহে খাত্তাবের পুত্র! আপনার মা নিপাত যাক! আপনি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন রাসূলুল্লাহর সা. নিয়োগ করা ব্যক্তিকে অপসারণ করতে? আল্লাহর কসম, আমার দ্বারা কক্ষণো তা হবেনা।’
’উমার রা. ফিরে এলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, সমাচার কি? বললেনঃ তোমাদের সকলের মা নিপাত যাক! তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের খলীফার নিকট থেকে অনেক কিছুই আমাকে শুনতে হলো।
যুবক কমাণ্ডারের নেতৃত্বে বাহিনী মদীনা থেকে রওয়ানা হলো। খলীফা আবু বকর রা. চললেন কিছুদূর এগিয়ে দিতে। উসামা ঘোড়ার পিঠে, খলীফা পায়ে হেঁটে। উসামা বললেনঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ সা. খলীফা! আল্লাহর কসম, হয় আপনি ঘোড়ায় উঠুন, না হয় আমি নেমে পড়ি।’ খলীফা বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, তুমিও নামবে না, আমিও উঠবো না।
কিছুক্ষণ আল্লাহর পথে আমার পদযুগল ধুলিমলিন হতে দোষ কি?’ তারপর উসামাকে বললেনঃ ‘তোমার দ্বীন, তোমার আমানতদারী এবং তোমার কাজের সমাপ্তি আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করলাম। রাসূলুল্লাহ সা. যে নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন, তা কার্যকর করা উপদেশ তোমাকে দিচ্ছি।’ তারপর উসামার দিকে একটু ঝুঁকে বললেনঃ ‘তুমি যদি ’উমারের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা ভালো মনে কর, তাকে আমার কাছে থেকে যাওয়ার অনুমতি দাও।’ উসামা আবু বকরের আবেদন মঞ্জুর করলেন। উমারকে মদীনায় খলীফার সংগে থাকার অনুমতি দিলেন।
উসামা রাসূলুল্লাহর সা. আদেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী ফিলিস্তিনের ‘বালকা’ ও ‘কিলায়াতুত দারুম’ সীমান্ত পদানত করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের জন্য রোমান ভীতি চিরতরে দূরীভূত হয় এবং গোটা সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিজয়দ্বার উন্মুক্ত হয়।
এ অভিযানে তিনি তাঁর পিতার হত্যাকারীকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রাতিশোধ নেন। যে ঘোড়ার ওপর তাঁর পিতা শহীদ হয়েছিলেন, তার পিঠে বিপুল পরিমাণ গণিমাতের ধন সম্পদ বোঝাই করে তিনি বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে এলেন। খলীফা আবু বকর রা. মুহাজির ও আনসারদের বিরাট একটি দল সহ মদীনার উপকণ্ঠে তাঁকে স্বগত জানান।
উসামা মদীনায় পৌঁছে মসজিদে নববীতে দু’রাকায়াত নামায আদায় করে বাড়ী যান। ঐতিহাসিকরা তাঁর এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ ‘উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও গণিমাত লাভকারী অন্য কোন বাহিনী আর দেখা যায়নি।’
রাসূলুল্লাহর সা. অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য উসামা মুসলিম সমাজের ব্যাপক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার রা. নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার অপেক্ষা উসামার ভাতা বেশী নির্ধারণ করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ক্ষব্ধ হয়ে অভিযোগ করেনঃ ‘আব্বা, উসামার ভাতা চার হাজার, আর আমার ভাতা তিন হাজার। আমার পিতা অপেক্ষা তাঁর পিতা অধিক মর্যাদাবান ছিলেন না এবং আমার থেকেও তাঁর মার্যাদা বেশী নয়।’ জবাবে হযরত উমার বলেনঃ ‘আফসোস! তোমার পিতার চেয়ে তার পিতা রাসূলুল্লাহর সা. অধিক প্রিয় ছিলেন এবং তোমার থেকেও সে রাসূলুল্লাহর সা. বেশী প্রিয় ছিল।’ হযরত আবদুল্লাহ রা. আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি।
উসামার সাথে খলীফা ’উমারের দেখা হলেই বলতেনঃ ‘স্বাগতম, আমার আমীর।’ এমন সম্বোধনে কেউ বিস্মিত হলে তিনি বলতেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ সা. তাকে আমার আমীর বা নেতা বানিয়েছিলেন।
হযরত উসমানের রা. খিলাফতকালে ফিতনা-ফাসাদের আশংকায় রাষ্ট্রীয় কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে হিতাকাংখী মুসলিম হিসাবে সর্বদা খলীফাকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং গোপনে গণ-অসন্তোষের বিষয়ে খলীফার সাথে আলোচনা করতেন।
হযরত উসমানের শাহাদাতের পর যখন বিশৃংখলা দেখা দিল, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলেন। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার বিরোধ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেন। এ সময় হযরত আলীকে একবার তিনি বলে পাঠালেন, ‘আপনি যদি বাঘের চোয়ালের মধ্যে ঢুকতেন, আমিও সন্তুষ্টচিত্তে ঢুকে যেতাম।
কিন্তু এ ব্যাপারে অংশগ্রহণের আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’ মুসলমানদের রক্তপাতের ভয়ে যদিও তিনি এ দ্বন্দ্বে জড়াতে চাননি, তবে তিনি আলীকে রা. সত্যপন্থী বলে মনে করতেন। এ কারণে, আলীকে সাহায্য না করার জন্য শেষ জীবনে তাওবাহ করেছেন।
হযরত উসামা প্রতিপালিত হয়েছিলেন নবীগৃহে। এ কারণে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া তাঁর উচিত ছিল। রাসূলুল্লাহর সা. ওয়াফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আঠারো বছর। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহর সা. দীর্ঘ সাহচর্য লাভের সুযোগ তিনি পাননি। এ কারণে, এ ক্ষেত্রে তিনি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন উমার প্রমুখ বিদ্বান সাহাবীদের মত আশানুরূপ সাফল্য লাভ করেননি।
তা সত্ত্বেও যা তিনি অর্জন করেছিলেন তা মোটেও অকিঞ্চিৎকর নয়। তিনি নবীর সা. বহু বাণী স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবীরাও মাঝে মাঝে শরীয়াতের নির্দেশ জানার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে শরীয়াতের কোন নির্দেশ না পেয়ে উসামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে কিছু শুনেছেন কি? তিনি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. একটি বাণী সা’দের নিকট বর্ণনা করেন।
তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট একশ’ আটাশটি। তন্মধ্যে পনেরটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। হযরত হাসান, মুহাম্মাদ ইবন আব্বাস, আবু হুরাইরা, কুরাইব, আবু উসমান নাহদী, ’আমর ইবন উসমান, আবু ওয়ায়িল, আমের ইবন সা’দ, হাসান বসরী রা. প্রমুখ সাহাবী ও তাবঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
যেহেতু নবীগৃতে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁর যাতায়াত ছিল অবাধ, এ কারণে নবীর সা. শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল। অধিকাংশ সফরে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একই বাহনে আরোহী হওয়ার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাতের সুযোগও বেশী পরিমাণে লাভ করেন। অজু ও পাক পবিত্রতার পানি তিনিই অধিকাংশ সময় এগিয়ে দিতেন।
অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। ইফ্ক বা হযরত আয়িশার রা. প্রতি মুনাফিকদের বানোয়াট ও অশালীন উক্তি ছড়িয়ে পড়লে রাসূল সা. ঘনিষ্ঠ যে দু’ব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন, তারা ছিলেন হযরত আলী ও উসামা রা.।
এ মহান সেনানায়ক হযরত মুয়াবিয়ার খিলাফত কালের শেষ দিকে হিজরী ৫৪ সনে ৬০ বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন।
মুয়ায্যিনুর রাসূল হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম সেই মহান সাহাবী যাঁর জন্য সপ্তম আকাশের ওপর থেকে নবী করীমকে সা. তিরস্কার করা হয়েছে এবং যাঁর শানে আল্লাহর নিকট থেকে হযরত জিবরীল আ. অহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অবতরণ করেছেন। তিনি সেই গর্বিত মহাপুরুষ যাঁর সম্পর্কে আল-কুরআনের সর্বমোট ষোলটি আয়াত নাযিল হয়েছে।
মদীনাবাসীরা তাঁকে ডাকতেন আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বলে। তবে ইরাকীদের নিকট তিনি ‘উমার ইবন উম্মে মাকতুম’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। তিনি ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়ালিদের মামাতো ভাই। তাঁর পিতা কায়েস বিন যায়িদ ও মাতা আতিকা বিনতু আবদিল্লাহ। আবদুল্লাহকে অন্ধ অবস্থায় প্রসব করেনে, এ কারণে মা ‘আতিকা উম্মু মাকতুম’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। মাকতুম অর্থ অন্ধ এবং উম্মু মাকতুম- অন্ধের মা।
বাহ্যিক চক্ষু তাঁর ছিল না। তবে একটি তীক্ষ্ণ অন্তর্চক্ষু তিনি লাভ করেছিলেন। মক্কায় ইসলামের আলোকরশ্মি আত্মপ্রকাশের সূচনা কালটি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্তর্চক্ষু উন্মুক্ত করে দেন। তিনি ঈমান আনেন। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের প্রথম পর্বের বিশ্বাসীদের অন্যতম। মক্কার মুসলমানদের কুরবানী, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার অংশীদার ছিলেন তিনিও। অন্যদের মত তিনিও শিকার হয়েছিলেন কুরাইশদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের।
তাদের হাজারো জুলুম-অত্যাচারে তিনি একটুও দমেননি, একটুও সাহসহারা হননি, অথবা বলা যায়, তাঁর ঈমান কখনো দুর্বল হয়ে পড়েনি। তাদের জুলুম-অত্যাচার যতই বৃদ্ধি পেয়েছিল, তিনিও তত বেশী করে আল্লাহর-দ্বীনকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর সংগে সংগে আল্লাহর কিতাবের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল, শরীয়াতের সমঝও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁর সময় অসময়ে যাতায়াতও বেড়ে গিয়েছিল।
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা ও পবিত্র কুরআন হিফ্জ করার প্রতি তাঁর আগ্রহ এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, এ ব্যাপারে প্রতিটি সুযোগকে তিনি গনিমত মনে করতেন এবং প্রতিটি মুহূর্তে কাজে লাগাতেন। আগ্রহের আতিশয্যের কারণে অনেক সময় রাসূলুল্লাহর সা. নিজের জন্য এমনকি অন্যের জন্য নির্ধারিত সময়টুকুতেও তিনি ভাগ বসাতেন।
এটা সেই সময়ের কথা যখন রাসূলুল্লাহর সা. মক্কার কুরাইশ নেতৃবর্গের ভীষণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি দারুণ আগ্রহী। একদিন তিনি মিলিত হলেন, ‘উতবা ইবন রাবীয়া, শায়বা ইবন রাবীয়া, আমর ইবন হিশাম উরফে আবু জাহল, উমাইয়া ইবন খালফ এবং খালিদ সাইফুল্লাহর পিতা ওয়ালিদ ইবন মুগীরার সাথে।
তিনি একেক জনের কাছে যাচ্ছেন, শলাপরামর্শ করছেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। তিনি আশা করছেন, তারা তাঁর দাওয়াত কবুল করুক অথবা কমপক্ষে তাঁর সংগী-সাথীদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে বিরত থাকুক। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি ব্যস্ত, এমন সময় সম্পূর্ণ অনাহূতভঅবে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে হাজির। বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার কিছু আমাকে শিখিয়ে দিন।
রাসূল সা. তাঁর কথায় বিশেষ একটা গুরুত্ব না দিয়ে কুরাইশ নেতৃবর্গের পতি মনোযোগী থাকলেন। এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাতে আল্লাহর দ্বীনের সম্মান বৃদ্ধি পাবে ও দাওয়াতী কাজের সুবিধা হবে। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সাথে আলোচনা-পরামর্শ শেষ করে যেইনা গৃহের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছেন অমনি আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পাকড়াও করলেন। তিরস্কার করে অহী নাযিল করলেনঃ
‘সে ভ্রু কুঞ্চিত করলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এলো। তুমি কেমন করে জানবে- সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসতো। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করেনা, তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছো। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে যে তোমার দিকে ছুটে এলো, আর সে সশংকচিত্ত, তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে। না, এরূপ আচরণ অনুচিত। এ তো উপদেশবাণী। যে ইচ্ছে করবে স্মরণ রাখবে। তা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।’ (আবাসাঃ ১-১৬)
এই অন্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমের শানে মোট ষোলটি আয়াত সহ হযরত জিবরীল আল-আমীন সেদিন অবতরণ করেছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. অন্তঃকরণে। আয়াতগুলি আজ পর্যন্ত পঠিত হয়ে আসছে এবং যতদিন এ ধরাপৃষ্ঠে মানব জাতির জীবনধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন তা পঠিত হবে।
সেই দিন থেকে রাসূল সা. আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমকে বিশেষ সমাদর করতেন। তিনি এলে ডেকে কাছে বসাতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন এবং তাঁর কিছু প্রয়োজন থাকলে তা পূরণ করতেন। হযরত আয়িশা রা. তাঁকে লেবু ও মধুর সরবত বানিয়ে পান করাতেন, তিনি বলেনঃ ‘আয়াত নাযিল হওয়ার পর এ ছিল তাঁর জন্য নির্ধারিত।’ এত আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তিনি তো সেই ব্যক্তি যাঁর কারণে সপ্তম আকাশের ওপর থেকে তাঁকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে।
রাসূল সা. ও মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের কঠোরতা ও অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমা ছেড়ে গেল, আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে হিজরাতের অনুমতি প্রদান করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন তাঁদেরই একজন যারা খুব দ্রুত দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এবং হযরত মুসয়াব ইবন ’উমাইর রা. সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মক্কা থেকে মদীনায় উপনীত হন।
আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম মদীনায় পৌঁছে বন্ধু মুসয়াব ইবন উমাইরকে সংগে নিয়ে মানুষের বাড়ীতে যেয়ে যেয়ে কুরআন ও আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দিতে শুরু করেন। হযরত বাররা ইবন আবিব রা. বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরাত করে মদীনায় আমাদের নিকট আসনে মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম রা.। তাঁরা মদীনায় এসেই আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।’
রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে এলেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ও বিলাল ইবন রাবাহকে মুসলমানদের মুয়ায্যিন নিয়োগ করেন। তাঁরা দু’জন ছিলেন মুসলিম উম্মাতের প্রথম মুয়ায্যিন। এভাবে তাঁরা প্রতিদিন পাঁচবার কালেমাতুত তাওহীদের প্রচার, মানুষকে সৎকর্মের দিকে আহ্বান ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহদানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। বিলাল আযান দিতেন, আর ইবন উম্মে মাকতুম দিতেন ইকামাত।
মাঝে মাঝে আযান দিতেন ইবন উম্মে মাকতুম, আর ইকামাতে দিতেন বিলাল রা.। রমযান মাসে তাঁরা অন্য একটি কাজও করতেন। মদীনার মুসলমানরা তাঁদের একজনের আযান শুনে সেহরী খাওয়া শুরু করতেন এবং অন্যজনের আযান শুনে খাওয়া বন্ধ করতেন। বিলালের আযান শুনে লোকেরা সেহরীর জন্য জেগে উঠতো। এদিকে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম প্রতীক্ষায় থাকতেন সুবহে সাদিকের সুবহে সাদিক হওয়ার সাথে সাথে তিনি আযান দিতেন, আর সে আযান শুনে লোকেরা খাওয়া বন্ধ করতো।
রাসূলুল্লাহর সা. হিজরাতের যুদ্ধ-বিগ্রহের পালা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইবন উম্মে মাকতুম স্বীয় অক্ষমতার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণে অপারগ ছিলেন। বদর যুদ্ধের পর আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীর ওপর কিছু আয়াত নাযিল করেন। আয়াতগুলি মুজাহিদদের সুমহান মর্যাদা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হয়ে যারা গৃহে অবস্থান করেন, তাদের ওপর মুজাহিদদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। আয়াতগুলির বিষয়বস্তু ইবন উম্মে মাকতুমের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুজাহিদদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি ভীষণ ব্যথিত হন। যখন এ আয়াত নাযিল হলোঃ
‘গৃহে অবস্থানকারী মু’মিনগণ এবং আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদগণ সমমর্যাদার অধিকারী হবে না।’ রাসূলুল্লাহ সা. কাতিবে অহী হযরত যায়িদ বিন সাবিতকে রা. আয়াতটি লিখতে বললেন। এমন সময় ইবন উম্মে মাকতুম সেখানে পৌঁছলেন। আরজ করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, সক্ষম হলে আমিও তো জিহাদে অংশগ্রহণ করে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করতে পারতাম।’
তারপর অত্যন্ত বিনীতভঅবে আল্লাহর নিকট দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ আমার অপারগতা সম্পর্কে অহী নাযিল করুন, হে আল্লাহ আমার ওজর সম্পর্কে অহী নাযিল করুন।’ তাঁর এ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহর নিকট এতই মনঃপূত হয়েছিল যে, সংগে সংগে অহী নাযিল করে অনন্তকালের জন্য জগতের সকল অক্ষম ব্যক্তিদের জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করেন।
নাযিল হয়ঃ
لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
‘ওজরগ্রস্তরা ছাড়া যেসব মুসলমান গৃহে অবস্থান করে, মর্যাদায় তারা তাদের সমকক্ষ নয়, যারা জান মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।’ এখানে [غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ ] বাক্যাংশ দ্বারা সকল অক্ষম ব্যক্তিকে জিহাদের হুকুম থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে এই হুকুমের কারণে তাঁর জিহাদে গমনের উৎসাহ কমার পরিবর্তে আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁর মহান অন্তঃকরণ অক্ষমদের সাথে ঘরে বসে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মহান অন্তঃকরণ সর্বদাই মহৎ কাজ ছাড়া পরিতুষ্ট হতে পারে না। ইবন হাজার আসকিলানী ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে বলেনঃ অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও কখনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। মানুষকে তিনি বলতেন, ‘আমার হাতে পতাকা দিয়ে তোমরা আমাকে দু’সারির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দাও। আমি অন্ধ, পালানোর কোন ভয় নেই।’
হযরত ইবন উম্মে মাকতুম যদিও অক্ষমতার কারণে জিহাদের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত ছিলেন, তবে তার থেকে বড় গৌরব ও সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. যখন নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারদের সংগে নিয়ে মদীনার বাইরে কোন অভিযানে গমন করতেন, তখন ইবন উম্মে মাকতুমকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন।
এ সময় তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতির দায়্ত্ব পালন করতেন। সুতরাং আবওয়ার, বাওয়াত, যুল আসীর, জুহাইনা, সুয়াইক, গাতফান, হামরাউল আসাদ, নাজরান, যাতুর রুকা প্রভৃতি অভিযানের সময় মোট তের বার এ গৌরব তিনি অর্জন করেন। বদর যুদ্ধের সময় কিছুদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে হযরত আবু লুবাবাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর থেকে হযরত উমারের রা. খিলাফত কালের শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীর পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মতে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। তবে ইবন সা’দ তাঁর ‘তাবাকাতে’ যুবাইর ইবন বাককারের সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। অধিকাংশ সীরাত লেখক এই বর্ণনাকে অধিকতর সহীহ মনে করেছেন।
চতুর্দশ হিজরী সনে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা. সিদ্ধান্ত নিলেন পারস্য বাহিনীর সাথে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের। তিনি বিভিন্ন প্রদেশের ওয়ালীদের লিখলেনঃ
‘যার একখানা হাতিয়ার, একটি ঘোড়া বা উষ্ট্রী অথবা বুদ্ধিমত্তা আছে, এমন কাউকে বাদ দিবে না। তাদের প্রত্যেককে আমার নিকট জলদি পাঠিয়ে দেবে।’
মুসলিম জনগণ হযরত ফারুকে আজমের এ আহ্বানে ব্যাপকভাবে সাড়া দিল। চতুর্দিক থেকে মানুষ বন্যার স্রোতের ন্যায় মদীনার দিকে আসতে লাগলো। অন্ধ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমও ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি মুজাহিদদের কাতারে শামিল হয়ে চলে এলেন মদীনায়। খলীফা উমার রা. এই বিশাল বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে রা.। যাত্রাকালে খলীফা তাঁকে নানা বিষয়ে উপদেশ দান করে বিদায় জানালেন।
মুসলিম বাহিনী যখন কাদেসিয়ায় পৌঁছলো, হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বর্ম পরে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সামনে এলেন এবং মুসলিম বাহিনীর আলাম বা পতাকা বহনের দায়িত্বটি তাঁকে দেয়ার আহ্বান জানালেন। বললেনঃ হয় এ পতাকা সমুন্নত রাখবো, নয় মৃত্যুবরণ করবো।
এই কাদেসিয়া প্রান্তরে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে যে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় বিশ্বের সমর ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুব কমই আছে। অবশেষে চূড়ান্ত যুদ্ধের তৃতীয় দিনে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য ও সর্বাধিক গৌরবময় সিংহাসনের পতন ঘটে। আর সেইসাথে তাওহীদের পতাকা পত্ পত্ করে উড়তে থাকে এই সুবিশাল পৌত্তলিক ভূমিতে। অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এ মহাবিজয় অর্জিত হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাকতুমও ছিলেন সেই অগনিত শহীদদের একজন। যুদ্ধশেষে দেখা গেল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তিনি মুসলমানদের পতাকাটি জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে আছে।
ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন অন্ধ। মসজিদে নববী থেকে তাঁর বাড়ীটিও ছিল একটু দূরে। পথে নালা নর্দমা ঝোপ জংগল পড়তো। সব সময়ের জন্য কোন সাহায্যকারীও তাঁর ছিলনা। এত অসুবিধা সত্ত্বেও নিয়মিত মসজিদে নববীতে এসে নামায আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ একদিন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একজন অন্ধ, আমার বাড়ীটিও মসজিদ থেকে বেশ দূরে, আমাকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য একজন লোকও আছে তবে সে আমার মনঃপূত নয়।
এমতাবস্থায় আপনি আমাকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেবেন কি? তিনি বললেনঃ ‘তুমি আযান শুনতে পাও?’ বললামঃ হ্যাঁ। বললেনঃ তোমার জন্য আমি কোন অনুমতির পথ দেখতে পাচ্ছিনা। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাড়ী ও মসজিদের মধ্যে খেজুর বাগান ও ঝোপ-জংগল রয়েছে। সব সময় পথ দেখানো লোকও আমি রাখতে পারিনে।
এমতাবস্থায় আমি কি ঘরে নামায আদায় করতে পারি? তিনি বললেনঃ তুমি কি ইকামাতে শুনতে পাও? বললামঃ হ্যাঁ, রাসূল সা. বললেনঃ তা হলে তুমি মসজিদে এসেই নামায আদায় করো। (হায়াতুস সাহাবা, ৩য়, ১২১) আযান ও ইকামতের আওয়াজ তাঁর ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতো এ কারণে তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি পাননি। হযরত উমার রা. তাঁর খিলাফতকালে তাঁকে একজন রাহনুমা (পথ প্রদর্শক) দিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। হযরত আনাস ও যার বিন জাইশ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহজীবুল কামাল, ২৮৯)
কুরাইশদের মাঝে যখন এ কথাটি ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদ সা. মক্কায় নেই তখন একদিকে যেমন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ খবরটি বিশ্বাসই করত পারছিলনা, অন্য দিকে মক্কায় একটি ভীতির ভাবও ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে তারা বনু হাশিমের প্রতিটি বাড়ীতে তল্লাশী শুরু করে দেয়। মুহাম্মাদের সা. ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়ী-ঘর তল্লশী করতে করতে তারা আবু বকরের বাড়ীতে উপস্থিত হয়। তাদের সাড়া পেয়ে আবু বকরের মেয়ে আসমা বেরিয়ে আসেন। কুরাইশ নেতা আবু জাহল তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার আব্বা কোথায়?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তিনি এখন কোথায় তাতো আমি জানিনা।’
নরাধম আবু জাহল আসমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলে তাঁর কানের দুলটি ছিট্কে পড়ে এবং তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
কুরাইশদের যখন স্থির বিশ্বাস হলো যে, মুহাম্মাদ সা. সত্যি সত্যি মক্কা থেকে চলে গেছেন, তখন তাদের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। তারা একদল পদচিহ্ন বিশারদকে পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য লাগিয়ে দেয়। পদচিহ্ন বিশারদরা ‘সাওর’ পর্বতের গুহার কাছে এসে কুরাইশদের বললেো আল্লাহর কসম, তোমাদের সাথী মুহাম্মাদ সা. এ গুহা ছেড়ে এখনও কোথাও যায়নি।’ আসলে তাদের এ অনুমান সঠিক ছিল। মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথী আবু বকর তখনও সেই গুহার মধ্যে।
আর কুরাইশরা তাঁদের মাথার ওপরে। এমন কি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. গুহার ওপরের দিকে তাদের মাথার ওপর বিচরণকারী কুরাইশদের পা-ও দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ দু’টি পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল। ভালোবাসা, দরদ ও ভর্ৎসনা মিশ্রিত দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দিকে তাকালেন। ফিস ফিস করে আবু বকর বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, আমার নিজের জানের ভয়ে নয়, আপনার প্রতি তাদের কোন দুর্ব্যবহার আমাকে দেখতে হয়, এ ভয়ে আমি কাঁদছি”। তাঁকে আশ্বস্ত করে রাসূল সা. বললেন, ‘আবু বকর, দুশ্চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’
আল্লাহ তায়ালা আবু বকরের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন। তবে তিনি বার বার মাথার ওপর চলাচলরত কুরাইশদের পায়ের দিকে তাকাতে লাগলেন। এক সময় তিনি রাসূলকে সা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাদের কেউ তার দু’পায়ের পাতার দিতে তাকালেই আমাদের দেখে ফেলবে।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি কি মনে করেছো আমরা মাত্র দু’জন? তৃতীয় একজন, আল্লাহও আমাদের সাথে আছেন।’
সেই মুহূর্তে তাঁরা দু’জন কুরাইশদের এক যুবককে বলতে শুনলেন, ‘তোমরা সবাই গুহার দিকে এসো, আমরা একটু ভেতরটা দেখবো।’ উমাইয়্যা ইবন খালফ তাকে একটু বিদ্রুপ করে বললো, ‘গুহার মুখে এই মাকড়সা ও তার বাসা দেখতে পাওনা? এগুলি মুহাম্মাদের জন্মেরও আগে থেকে এখানে আছে।’ তবে আবু জাহল বললো, লাত ও উজ্জার শপথ, আমার মনে হচ্ছে তারা আমাদের ধারে কাছে কোথাও আছে। আমাদের কথা তারা শুনছে এবং আমাদের কার্যকলাপও তারা দেখছে। কিন্তু তার ইন্দ্রজালেও আমাদের দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না।’
যা হোক, কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সা. খুঁজে বের করার ব্যাপারে একেবারে হাত গুটিয়ে নিলনা এবং তাঁর পিছু ধারওয়া করার সিদ্ধান্তেও তাদের কোন নড়চড় হলো না। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে বসবাসরত গোত্রগুলিতে তারা ঘোষণা করে দিল, কোন ব্যক্তি মুহাম্মাদকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় ধরে দিতে পারলে তাকে একশ’টি উন্নত জাতের উট পুরস্কার দেয়া হবে।
সুরাকা ইবন মালিক আল-মাদলাজী তখন মক্কার অনতিদূরে ‘কুদাইদ’ নামক স্থানে তার গোত্রের একটি আড্ডায় অবস্থান করছিল। এমন সময় কুরাইশদের একজন দূত সেখানে উপস্থিত হয়ে মুহাম্মাদকে সা. জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দেয়ার ব্যাপারে কুরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের কথা প্রচার করলো।
একশ’ উটের কথঅ শুনে সুরাকার মধ্যে লালসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। কিন্তু অন্যের মধ্যেও এ লালসা সঞ্চার হতে পারে এ ভয়ে সে কোন কথা না বলে নিজেকে সামলে নিল।
সুরাকা আড্ডা থেকে ওঠার আগেই সেখানে তার গোত্রের অন্য একটি লোক এসে বললো, ‘আল্লাহর শপথ, আমার পাশ দিয়ে এখনও তিন জন লোক চলে গেল, আমার ধারণা তারা মুহাম্মাদ, আবু বকর ও তাদের গাইডই হবে।’
সুরাকা বললো, ‘না, তা না। তারা হচ্ছে অমুক গোত্রের লোক। তাদের উট হারিয়ে গেছে তাই তারা তালাশ করছে।’ ‘তা হতে পারে’- এ কথা বলে লোকটি চুপ করে গেল।
আড্ডা থেকে সংগে সংগে উঠে গেলে অন্যদের মনে সন্দেহ হতে পারে, এ কারণে সে আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকলো। আড্ডায় উপস্থিত লোকেরা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হলে এক সুযোগে সে চুপে চুপে বেরিয়ে গেল। আড্ডা থেকে বেরিয়েই সে বাড়ীর দিকে গেলো। বাড়ীতে পৌঁছেই দাসীকে বললো, ‘তুমি চুপে চুপে মানুষে না দেখে এমনভাবে আমার ঘোড়াটি অমুক উপত্যকায় বেঁধে রাখবে।’ আর দাসকে বললেো ‘তুমি এ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়ীর পিছন দিক থেকে এমনভঅবে বেরিয়ে যাবে যেন কেউ না দেখে এবং ঘোড়ার আশে পাশে কোন একস্থানে রেখে দেবে।’
সুরাকা বর্ম পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো এবং মুহাম্মাদকে পাকড়াও করার জন্য দ্রুত ঘোড়া হাঁকালো, যাতে মুহাম্মাদকে সা. ধরে দিয়ে অন্য কেউ এ পুরস্কার ছিনিয়ে নিতে না পারে। সে ছিল তার গোত্রের দক্ষ ঘোড় সওয়ারদের অন্যতম। সে ছিল দীর্ঘদেহী, বিশাল বপুধারী, পদচিহ্ন বিশারদ ও বিপদে দারুণ ধৈর্যশীল। সর্বোপরি সে ছিল একজন বুদ্ধিমান কবি। তার ঘোড়াটি ছিল উন্নত জাতের।
সুরাকা সামনে এগিয়ে চললো। কিছুদূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি হোঁচট খেলো এবং সে পিঠ থেকে দূরে ছিট্কে পড়লো। এটাকে সে অশুভ লক্ষণ মনে করে বলে উঠলো, ‘একি? ওরে ঘোড়া, তুই নিপাত যা।’ এই বলে সে আবার ঘোড়ার পিঠে উঠলো। কিছু দূর যেতে না যেতেই ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। এবার তার অশুভ লক্ষণের ধারণা আরও বেড়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলো; কিন্তু এক শ’ উটের লোভ তাকে এ চিন্তা থেকে বিরত রাখলো।
দ্বিতীয়বার ঘোড়াটি যেখানে হোঁচট খেয়েছিল সেখান থেকে সামান্য দূরে সে দেখতে পেল মুহাম্মাদ সা. তাঁর দু’সঙ্গীকে, সংগে সংগে সে তার হাত ধনুকের দিকে বাড়ালো; কিন্তু সে হাতটি যেন একেবারে অসাড় হয়ে গেল। সে দেখতে পেল তার ঘোড়ার পা যেন শুকনো মাটিতে দেবে যাচ্ছে এবং সামনে থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়া উঠে ঘোড়া ও তার চোখ আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সে দ্রুত ঘোড়াটি হাঁকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘোড়াটি এমন স্থির হয়ে গেল, যেন তার পা লোহার পেরেক দিয়ে মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে।
অতঃপর সুরাকা রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের দিকে ফিরে অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘ওহে’ তোমরা তোমাদের প্রভুর দরবারে আমার ঘোড়ার পা মুক্ত হওয়ার জন্য দুআ করো। আমি তোমাদের কোন অকল্যাণ করবো না।’ রাসূল সা. দুআ করলেন। তার ঘোড়া মুক্ত হয়ে গেল। সংগে সংগে তার লালসাও আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
সে তার ঘোড়াটি আবার রাসূলের সা. দিকে হাঁকালো। এবার পূর্বের চেয়েও মারাত্মকভাবে তার ঘোড়ার পা মাটিতে আটকে গেল। এবারও সে রাসূলের সা. সাহায্য কামনা করে বললেো ‘আমার এ খাদ্য সামগ্রী, আসবাবপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র তোমরা নিয়ে নাও। আমি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি, মুক্তি পেলে আমি আমার পেছনে ধাবমান লোকদের তোমাদের থেকে অন্য দিকে হটিয়ে দেব।’
তাঁরা বললেন, ‘তোমার খাদ্য সামগ্রী ও আসবাবপত্রের প্রয়োজন আমাদের নেই। তবে তুমি লোকদের আমাদের থেকে দূরে হটিয়ে দেবে।’ অতঃপর রাসূল সা. তার জন্য দুআ করলেন। তার ঘোড়াটি মুক্ত হয়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে ডেকে বললো, ‘তোমরা একটু থাম, তোমাদের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই। আল্লাহর কসম, তোমাদের কোন অকল্যাণ আমি করবো না।’
রাসূল সা. ও আবু বকর উভয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের কাছে কী চাও?’ সে বললো, ‘আল্লাহ কসম, হে মুহাম্মাদ, আমি নিশ্চিতভাবে জানি শিগগিরই তোমার দ্বীন বিজয়ী হবে। আমার সাথে তুমি ওয়াদা কর, আমি যখন তোমার সাম্রাজ্যে যাব, তুমি আমাকে সম্মান দেবে। আর এ কথাটি একটু লিখে দাও।’
রাসূল সা. আবু বকরকে লিখতে বললেন। তিনি একখন্ড হাড়ের ওপর কথাগুলি লিখে তার হাতে দিলেন সুরাকা ফিরে যাবার উপক্রম করছে, এমন সময় রাসূল সা. তাকে বললেন, ‘সুরাকা, তুমি যখন কিসরার রাজকীয় পোশাক পরবে তখন কেমনে হবে?’
বিস্ময়ের সাথে সুরাকা বললো, ‘কিসরা ইবন হুরমুয?’ রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ, কিসরা ইবন হুরমুয।’
সুরাকা পেছন ফিরে চলে গেল। ফেরার পথে সে দেখতে পেল লোকেরা তখনও রাসূলকে সা. সন্ধান করে ফিরছে। সে তাদেরকে বললো, ‘তোমরা ফিরে যাও।’ আমি এ অঞ্চলে বহুদূর পর্যন্ত তাকে খুঁজেছি। আর তোমরা তো জান পদ-চিহ্ন অনুসরণের ক্ষেত্রে আমার যোগ্যতা কতখানি। তার এ কথায় লোকেরা ফিরে গেল।
মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের খবর সে সম্পূর্ণরূপে চেপে গেল। যখন তার স্থির বিশ্বাস হলো এত দিনে তাঁরা মদীনায় পৌছে কুরাইশদের শত্রুতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছেন, তখন সে তার ঘটনাটি প্রচার করলো। রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গে সুরাকার ভূমিকা ও আচরণের খবর যখন আবু জাহলের কানে গেল সে তার ভীরুতা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার না করার জন্য ভীষণ তিরস্কার করলো। উত্তরে সে তার স্বরচিত দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলোঃ
‘আল্লাহর শপথ, তুমি যদি দেখতে আবু হিকাম,
আমার ঘোড়ার ব্যাপারটি, যখন তার পা ডুবে যাচ্ছিল, তুমি জানতে
এবং তোমার কোন সংশয় থাকতো না, মুহাম্মাদ প্রকৃত রাসূল-
সুতরাং কে তাঁকে প্রতিরোধ করে?’
ইবন হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে শ্লোক দু’টি উল্লেখ করেছেনর।
সময় দ্রুত বয়ে চললো। একদিন যে মুহাম্মাদ সা. মক্কা থেকে রাতের অন্ধকারে গোপনে সরে গিয়েছিলেন, আবার তিনি বিজয়ীর বেশে হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীসহ প্রবেশ করলেন সেই মক্কা নগরীতে। অত্যাচারী ও অহংকারী কুরাইশ নেতৃবৃন্দ, যাদের দৌরাত্মে সর্বদা প্রকম্পিত থাকতো মক্কা, ভীত-বিহ্বল চিত্তে হাজির হলো মুহাম্মাদের সা. নিকট করুণা ভিক্ষার জন্য।
মহানুভব নবী সা. তাদের বললেন, ‘যাও তোমরা সবাই মুক্ত স্বাধীন।’
সুরাকা ইবনমালিক চললো রাসূলুল্লাহর সা. কাছে তার ইসলামের ঘোষনা দানের জন্য। সে সঙ্গে নিল দশ বছর পূর্বে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহর সা সেই অঙ্গীকার পত্রটি। পরবর্তীকালে সুরাকা বর্ণনা করেছেনঃ
‘আমি জি’রারা (মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থান) থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আসলাম। আনসারদের একদল সৈনিকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে তারা আমাকে তীরের বাট দিয়ে পিটাতে শুরু করে এবং বলতে থাকে, ‘দূর হও, দূর হও, কি চাও?’ তবুও আমি তাদের সারির মধ্যে ঢুকে পড়লাম এবং রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গেলাম। তিনি তখন তার উটনীর ওপর সওয়ার। আমি সেই অঙ্গীকার পত্রটিসহ হাত উঁচু করে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি সুরাকা ইবন মালিক। আর এই হলো আপনার অঙ্গীকার পত্র।’
রাসূল সা. বললেন, ‘সুরাকা, আমার কাছে এসো, আজ প্রতিশ্রুতি পালন ও সদ্ব্যবহারের দিন।’
আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গিয়ে তাঁর সামনে ইসলামের ঘোষনা দিলাম। এভাবে আমি তাঁর কল্যাণ ও বরকত লাভে ধন্য হলাম।’
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতে হযরত সুরাকা রা. ব্যথিত ও শোকাভিভূত হন। একশটি উটের লোভে যেদিন রাসূলুল্লাহকে সা. হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে দিনটির কথা ঘুরে ফিরে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠতে থাকে। এখন পৃথিবীর সকল উটও রাসূলুল্লাহর সা. একটি নখাগ্রেরও সমান নয়। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেই প্রশ্নটি বার বার আওড়াতেন, ‘সুরাকা, যেদিন তুমি কিসরার পোশাক পরবে, কেমন হবে?’ কিসরার পোশাক যে সত্যি তিনি পরবেন সে ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা।
সময় বয়ে চললো। ইসলামী খিলাফাতের দায়িত্ব হযরত উমার ফারুকের রা. হাতে ন্যস্ত হলো। তাঁর গৌরবমসয় যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ঝড়ের গতিতে পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলো। তাঁর পারস্যের দুর্গসমূহ তছনছ করে দিয়ে তাদের বাহিনীকে পরাজিত করে পারস্য-সিংহাসন দখল করলো।
হযরত উমারের রা. খিলাফাতকালের শেষ দিকে পারস্য জয়ের সুসংবাদ নিয়ে সেনাপতি সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের দূত পৌঁছলেন মদীনায়। তিনি সংগে নিয়ে এলেন পারস্যের গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ। গনীমাতের ধন-দৌলত উমারের সামনে স্তূপীকৃত করা হলে তিনি বিস্ময়ের সাথে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তার মধ্যে ছিল কিসরার মণি-মুক্তা খচিত মুকুট, সোনার জরি দেয়া কাপড়, মুক্তার হার এবং তার এমন চমৎকার দু’টি জামা যা ইতিপূর্বে আর কখনও হযরত উমার দেখেননি। তাছাড়া আর ছিল বহু অমূল্য জিনিস। হযরত উমার হাতের লাঠিটি দিয়ে এই মূল্যবান ধন-রত্ন উল্টাতে লাগলেন। তারপর চারপাশে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যারা এসব জিনিস থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে জমা দিয়েছে, নিশ্চয় তারা অত্যন্ত বিশ্বাসভঅজন।
হযরত আলী রা., তিনি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, বলেন, আমীরুল মু’মিনীন, আপনি বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি, আপনার প্রজারাও ভঙ্গ করেনি। আপনি যদি অন্যায়ভাবে খেতেন, তাহলে তারা খেত।
অতঃপর হযরত উমার রা. সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে নিজ হাতে তাঁকে কিসরার জামা, পাজামা, জুতো ও অন্যান্য পোশাক পরালেন। তাঁর কাঁধে ঝুলালেন কিসরার তরবারি, কোমরে বাঁধলেন বেল্ট, মাথায় রাখলেন মুকুট এবং তাঁর হাতে পরালেন বালা। কতই না চমৎকার!
হযরত উমার রা. সুরাকাকে পরাচ্ছেন কিসরার পোশাক, আর এ দিকে মুসলমানদের মুহূর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে মদীনার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে।
কিসরার পোশক পরা শেষ হলে সুরাকার দিকে ফিরে হযরত উমার রা. বললেন, ‘সাবাশ, সাবাশ, মুদলাজ গোত্রের ক্ষুদে এক বেদুঈনের মাথায় শোবা পাচ্ছে শাহানশাহ কিসরার মুকুট এবং হাত বালা।’ তারপর তিন আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ, এ সম্পদ তুমি রাসূলুল্লাহকে সা. দাওনি, অথচ তিনি ছিলেন তোমার কাছে আমার থেকে অধিক প্রিয় সম্মানিত।
তুমি দাওনি এ সম্পদ আবু বকরকেও। তিনিও ছিলেন তোমার নিকট আমার থেকেও অধিকতর প্রিয় মর্যাদাবান। আর তা দান করেছো আমাকে পরীক্ষার জন্য। আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’ অতঃপর তিনি সূরা মুমিনূনের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টি পাঠ করলেন, ‘তারা কি মনে করে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি তা দ্বারা তাদের সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।’ (সূরা মু’মিনূনঃ ৫৫-৫৬)
সকল সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন না করা পর্যন্ত তিনি সে মজলিস ত্যাগ করলেন না।
হযরত সুরাকা ইবন মালিকের এ কাহিনী ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদও আল-বারা ইবন আযিব ও আবু বকর সিদ্দীকের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
আবু আমর বলেন, সুরাকা ইবন মালিক খলীফা ’উসমানের খিলাফতকালে ২৪ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। কেউ কেউ বলেছেন, হযরত উসমানের পরে তিনি ইনতিকাল করেন।
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ ‘শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে (আবু জাহল) গালি দেবেনা। কারণ মৃতকে গালি দিলে জীবিতদের মনোকষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছেনা।’
নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন ইকরিমার বয়সের তৃতীয় দশকটি শেষ হতে চলেছে। কুরাইশদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাধিক সম্মানিত ও ধনশালী। মক্কার সম্ভ্রান্ত গৃহের সন্তান সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, মুস’য়াব ইবন উমাইর প্রমুখে রমত তাঁরও উচিত ছিল প্রথম স্তরেই ইসলাম গ্রহণ করা। কিন্তু তাঁর পিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
তাঁর পিতা আবু জাহল ছিল মক্কার সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাচারী, প্রথমযুগের মুশরিকদের নেতা ও কঠোর অত্যাচারী। আল্লাহতা’আলা তা অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে মু’মিনদের ঈমান পরীক্ষা করেছেন এবং সে পরীক্ষায় তাঁর সফলকাম হয়েছেন। তার ধোঁকার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্যতা যাচাই করেছেন এবং তাতে তাঁরা সফলকাম হয়েছেন। তার ধোঁকার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্যতা যাচাই করেছেন এবং তাতে তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।
পিতার নেতৃত্বে ইকরিমা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সা. শত্রুতায় আত্মনিয়োগ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কঠোর। তঁঅর অত্যাচারে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাঁর এ নিষ্ঠুরতা দেখে তঁঅর পিতা আবু জাহল পরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করতো।
তাঁর পিতা বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের নেতৃত্ব দেয়। সে লাত ও উজ্জার নামে শপথ করে যে, মুহাম্মাদের একটা হেনস্তা না করেমক্কায় ফিরবে না। বদরে ঘাঁটি গেড়ে দিন তিন অবস্থান করলো। উট জবেহ করলো, মদ পান করে মাতাল হলো এবং গালক-গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হলো। আবু জাহল যখন এ যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, ইকরিমা তখন তার ডান হাত-প্রধান সহযোগী। কিন্তু লাত ও উজ্জা এ যুদ্ধে আবু জাহলের ডাকে সাড়া দেয়নি, এ দু’টি উপাস্য মূর্তি তাকে কোন সাহায্য করতে পারেনি। পারা সম্ভবও ছিলো না।
বদরের ময়দানে আবু জাহল মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো। ইকরিমা নিজ চোখেই দেখলেন কিভাবে মুসলমানদের তীরের ফলা তাঁর পিতার রক্ত পান করছে এবং তিনি নিজ কানেই শুনতে পেলেন তাঁর পিতার মুখের অন্তিম চিৎকার ধ্বনিটি।
কুরাইশ নেতা আবু জাহলের মৃতদেহটি বদরে ফেলে রেখে ইকরিমা মক্কায় ফিরে এলেন। শোচনীয় পরাজয় তাঁকে পিতার লাশটি দাফনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। মুসলমানরা বদরে নিহত অন্যান্য মুশরিক সৈন্যদের সাথে তারও লাশটি ‘কালীব’ নামক কূপে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দেয়। এভাবেই এ অহঙ্কারী অত্যাচারী কুরাইশ নেতার দর্প চূর্ণ হয়।
এ দিন থেকেই ইসলামের সাথে ইকরিমার আচরণ নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ যাবত তিনি পিতার মান-মর্যাদা রক্ষার্থে ইসলামের সাথে দুশমনী করে এসেছেন। আর এখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন পিতার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের। বদরে অন্য যারা পিতৃহারা হয়েছিল, তিনি তাদের সাথে সম্মিলিতভাবে মুহাম্মাদের সা. বিরুদ্ধে মুশরিকদের অন্তরে শত্রুতার আগুন জ্বালিয়ে দিতে শুরু করলেন এবং তাদেরকে বদরে নিহতদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। এভাবেই উহুদের যুদ্ধটি সংগঠিত হয়।
ইকরিমা ইবন আবু জাহল উহুদের দিকে যাত্রা করলেন। সংগে তাঁর স্ত্রী উম্মু হাকীমও বদরে স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রহারা নারীদের সাথে চললেন। উদ্দেশ্য, তারা সেখানে যুদ্ধরত সৈনিকদের পশ্চাতে অবস্থঅন করে বাদ্য বাজাবে, কুরাইশদেরকে যুদ্ধে উৎসাহ দেবেন এবং পলায়ন উদ্যত সৈনিকদেরকে সাহস ও শক্তি যোগাবেন।
কুরাইশরা তাদের অশ্বারোহী সৈনিকদের ডান দিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও বাম দিকে ইকরিমা ইবন আবী জাহলকে নিয়োগ করলো। সেদিন তারা দু’জন সাহসিকতা ও রণকৌশলের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তাঁরা মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সাথীদের হাত থেকে বিজয়ের গৌরব ছিনিয়ে এনে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাই সেদিনকার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বলতে পেরেছিলেনঃ ‘এটা বদরের দিনের প্রতিশোধ।’
এরপর এলো খন্দকের যুদ্ধ। মুশরিক সৈন্যরা কয়েকদিন যাবত মদীনা অবরোধ করে রেখেছে। ইকরিমার ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে, তিনি তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠছেন। অবশেষে তিনি দেখতে পেলেন খন্দকের এক স্থানে সংকীর্ণ একটা পথ। তার মধ্য দিয়ে অতি কষ্টে তিনি তাঁর ঘোড়াটি ঢুকিয়ে দিলেন এবং খন্দক পার হয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে খন্দক পার হলো আরো কিছু মুশরিক সৈনিক। মুসলিম সৈনিকরা তাদেরকে তাড়া করে। ইকরিমা তাঁর অন্য সংগীদের সাথে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান, কিন্তু তাঁর একজন সংগী আমর ইবনু আবদে উদ্দ আল-আমিরী মুসলিম সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারায়।
মক্কা বিজয়ের দিন কুরাইশরা বুঝতে পেল মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথীদের বাধা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হবে না। তারা মুসলমানদের পথ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মুহাম্মাদ সা. ঘোষনা করলেনঃ মক্কাবাসীদের যারা মুসলিম সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, কেবল তাদের সাথেই যুদ্ধ করা হবে। তাছাড়া অন্য সকলকে ক্ষমা করা হবে।
ইকরিমা ইবনে আবী জাহল এবং আরো একদল সৈনিক কুরাইশদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খাড়া করেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম সৈনিকদের ছোট্ট একটি দল তাদের এ প্রতিরোধ ব্যুহ তছনছ করে দেয়। তাঁর তাদের অনেককে হত্যা করে এবং অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এ পলায়নকারীদের মধ্যে ইকরিমা ইবন আবী জাহলও ছিলেন।
মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর ইকরিমা ইবন আবী জাহল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই প্রথম বারের মত তাঁর শক্তি মদমত্ততা থেকে সম্বিত ফিরে পেলেনে। তিনি বুঝতে পারলেন মক্কা আর তাঁর জন্যে নিরাপদ নয়। এদিকে রাসূল সা. মক্কাবাসীদের সকলের অতীত আচরণ ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে তাদেরকে এ ক্ষমার আওতা থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করেন। কা’বার গিলাফের নীচে পাওয়া গেলেও তিনি তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। হত্যার নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষস্থানে ইকরিমার নামটি। তিনি কোন উপায়ান্তর না দেখে গোপনে মক্কা থেকে বের হয়ে ইয়ামনের দিকে যাত্রা করেন।
এদিকে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম ও হিন্দা বিনতু উতবা গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। তাদের সাথে গেলেন আরো অনেক মহিলা। উদেদ্শ্য তাঁদের, রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত হওয়া। তাঁরা যখন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছলেন, তখন তার কাছে বসা ছিলেন তাঁর দু’স্ত্রী, কন্যা ফাতিমা ও বনী আবদুল মুত্তালিবের আরো বহু মহিলা। মাথা ও মুখ ঢাকা অবস্থায় হিন্দা কথা বললেন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে। হিন্দা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমীর মুয়াবিয়ার মা। উহুদের যুদ্ধে হযরত হামযার রা. কলিজা চিবিয়েছিলেন ইনিই। তাই মক্কা বিজয়ের দিনে লজ্জা ও অনুশোচনায় মাথা ও মুখ ঢেকে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে উপস্থিত হন।
‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর মনোনীত দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন। আপনার ও আমার মাঝে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে সে সূত্রে আমি আপনার নিকট ভালো ব্যবহার আশা করি। এখন আমি একজন ঈমানদার ও বিশ্বাসী নারী’ এ কথা বলেই তিনি তাঁর অবগুণ্ঠন খুলে পরিচয় দেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি হিন্দা বিনতু উতবা’। রাসূল সা. বললেন, ‘খোশ আমদেদ।’ হিন্দা বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, হেয় ও অপমানিত করার জন্য আপনার বাড়ী থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয় বাড়ী ধরাপষ্ঠে এর আগে আর ছিলনা। আর এখন আপনার বাড়ী থেকে অধিক সম্মানিত বাড়ী আমার নিকট দ্বিতীয়টি নেই।’
রাসুল সা. বললেনঃ আরো অনেক বেশী।
এরপর ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়িয়ে ইসলাম গ্রহণের স্বীকৃতি দিলেন। তারপর বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি ইকরিমাকে হত্যা করতে পারেন, এ ভয়ে সে ইয়ামনের দিকে পালিয়ে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন আল্লাহ আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন। রাসুল সা. বললেন, ‘সে নিরাপদ’।
সেই মুহূর্তে উম্মু হাকীম তঁঅর স্বামী ইকরিমার সন্ধানে বের হলেন। সংগে নিলেন তাঁর এক রূমী ক্রীতদাস। তারা দু’জন রাস্তায় চলছেন। পথিমধ্যে দাসটির মনে তার মনিবের প্রতি অসৎ কামনা দেখা দিল। সে চাইলো তাঁকে ভোগ করতে, আর তিনি নানা রকম টালবাহানা করে সময় কাটাতে লাগলেন। এভাবে তারা একটি আরব গোত্রে পৌঁছলেন। সেখানে উম্মু হাকীম তাদের সাহায্য কামনা করলেন। তারা তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দিল। তিনি তাঁর দাসটিকে তাদের জিম্মায় রেখে একাকী পথে বের হলেন। অবশেষে তিনি তিহামা অঞ্চলে সমুদ্র উপকূলে ইকরিমার দেখা পেলেন। সেখানে তিনি এক মাঝির সাথে কথা বলছেন তাঁকে পার করে দেওয়ার জন্য, আর মাঝি তাকে বলছেনঃ
– ‘সত্যবাদী হও’
ইকরিমা তাকে বললেন,
– ‘কিভাবে আমি সত্যবাদী হবো?’
মাঝি বললেন,
– ‘তুমি বলো, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।’
– ‘আমি তো শুধু এ কারণেই পালিয়েছি।’ তাদের দু’জনের এ কথোপকথের মাঝখানেই উম্মু হাকীম উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
‘হে আমার চাচাতো ভাই, আমি সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম ব্যক্তির নিকট থেকে আসছি। আমি তাঁর কাছে তোমার জন্য আমার চেয়েছি। তিনি তোমার আমার মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং এরপরও তুমি নিজেকে ধ্বংস করোনা।’
এ কথা শুনে ইকরিমা জিজ্ঞেস করলেনঃ
– ‘তুমি নিজেই তাঁর সাথে কথা বলেছো?’
তিনি বললেনঃ
– ‘হাঁ, আমিই তাঁর সাথে কথা বলেছি, এবং তিনি তোমাকে আমান দিয়েছেন’- এভাবে বার বার তিনি তাঁকে আমানের কথা শুনাতে লাগলেন ও তাঁকে আশ্বাস দিতে লাগলেন। অবশেষে আশ্বস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীর সাথে ফিরে চললেন।
পথে চলতে চলতে উম্মু হাকীম তাঁর দাসটির কাণ্ড-কারখানার কথা স্বামীকে খুলে বললেন। ফেরার পথে ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই ইকরিমা দাসটিকে হত্যা করেন।
পথিমধ্যে তাঁরা এক বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেন। ইকরিমা চাইলেন একান্তে তাঁর স্ত্রীর সাথে মিলিত হতো। কিন্তু স্ত্রী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
– ‘আমি একজন মুসলিম নারী এবং আপনি এখনও একজন মুশরিক। স্ত্রীর কথা শুনে ইকরিমা অবাক হয়ে গেলেন।
তিনি বললেন,
– ‘তোমার ও আমার মিলনের মাঝখানে যে ব্যাপারটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা তো খুব বিরাট ব্যাপার!’
এভাবে ইকরিমা যখন মক্কায় নিকটবর্তী হলেন, তখন রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের বললেনঃ ‘খুব শিগ্গিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গালি দেবে না। কারণ মৃতকে গালি দিলে তা জীবিতদের মনে কষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছে না।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইকরিমা তাঁর স্ত্রীসহ রাসূলুল্লাহর সা. কাছে উপস্থিত হলেন। রাসুল সা. তাঁকে দেখেই আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং চাদর গায়ে না জড়িয়েই তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর রাসুল সা. বসলেন। ইকরিমা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
– ‘ইয়া মুহাম্মাদ, উম্মু হাকীম আমাকে বলেছেন, আপনি আমাকে আমান দিয়েছেন।’
নবী সা. বললেন, ‘সে সত্যই বলেছে। তুমি নিরাপদ।’
ইকরিমা বললেন, ‘মুহাম্মাদ, আপনি কিসের দাওয়াত দিয়ে থাকেন?’
রাসূল সা. বললেন, ‘আমি তোমাকে দাওয়াত দিচ্ছি তুমি সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং আমি আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর রাসুল। তারপর তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত দান করবে।’ এভাবে তিনি ইসলামের সবগুলি আরকান বর্ণনা করলেন।
ইকরিমা বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আপনি একমাত্র সত্যের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন এবং কল্যাণের নির্দেশ দিচ্ছেন।’ তারপর তিনি বলতে লাগলেনঃ
– ‘এ দাওয়াতের পূর্বেই আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সবচেয়ে সৎকর্মশীল।’ তারপর একথা বলতে বলতে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্নাকা আবদুহূ ওয়া রাসূলুহু।’ একথার পর তিনি বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি বলতে পারি, এমন কিছু ভাল কথা আমাকে শিখিয়ে দিন।’
রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি বলো, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদান্ আবদুহু
ওয়া রাসূলুহু।’ রাসূল সা. বললেন, ‘‘তুমি বলেো ‘উশহিদুল্লাহা ওয়া উশহিদু মান হাদারা আন্নি মুসলিমুন মুজাহিদুন মুহাজিরুন’- আল্লাহ ও উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে আমি বলছি, আমি একজন মুসলিম, মুজাহিদ ও মুহাজির।’’
ইকরিমা তা-ই বললেন। এ সময় রাসুল সা. তাঁকে বললেন, ‘অন্য কাউকে আমি দিচ্ছি, এমন কোন কিছু আজ যদি আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দেব।’
ইকরিমা বললেন, ‘আমি আপনার কাছে চাচ্ছি, যত শত্রুতা আমি আপনার সাথে করেছি, যত যুদ্ধে আমি আপনার মুখোমুখি হয়েছি এবং আপনার সামনে অথবা পশ্চাতে যত কথাই আমি আপনার বিরুদ্ধে বলেছি- সবকিছুর জন্য আপনি আল্লাহর কাছে আমার মাগফিরাত কামনা করুন।
’ তক্ষুণি রাসূল সা. তাঁর জন্য দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ, যত শত্রুতাই সে আমার সাথে করেছে, তোমার নূরকে নিভিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে যত পথই সে ভ্রমণ করেছে, সবকিছু্ই তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা অগোচরে আমার মানহানিকর যত কথাই সে বলেছে, তা-ও তুমি ক্ষমা করে দাও।’
আনন্দে ইকরিমার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃস্টির জন্য যতকিছু আমি ব্যয় করেছি তার দ্বিগুণ আমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবো এবং আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি উদ্দেশ্যে যত যুদ্ধ আমি করেছি, আর দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর রাস্তায় করবো।’
এ দিন থেকেই তিনি দাওয়াতের মিছিলে প্রবেশ করলেন। তিনি হলেন যুদ্ধের ময়দানে দুঃসাহসী অশ্বারোহী, মসজিদে সর্বাদিক ইবাদতকারী, রাত্রি জাগরণকারী ও আল্লাহর কিতাব পাঠকারী। পবিত্র কুরআন মুখের ওপর রেখে তিনি বলতেনঃ ‘কিতাবু রাব্বি কালামু রাব্বি- আমার রবের কিতাব, আমার প্রভুর কালাম।’ একথা বলতেন, আর আকুল হয়ে কাঁদতেন।
রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ইকরিমা যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানরা যত যুদ্ধই করেছে, তার প্রত্যেকটিকে তিনি অংশ নেন এবং যত অভিযানেই তারা বের হয়েছে তিনি থাকেন তার পুরোভাগে।
ইয়ারমুকের যুদ্ধে গ্রীষ্মের দুপুরে পিপাসিত ব্যক্তি যেমন ঠাণ্ডা পানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি তিনি শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধের কোন এক পর্যায়ে মুসলমানদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হলো, তিনি তখন ঘোড়া থেকে নেমে তরবারি কোষ-মুক্ত করেন এবং রোমান বাহিনীর অভ্যন্তরভাগে ঢুকে পড়েছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ তাঁর দিকে ছুটে যান এবং বলেন, ‘ইকরিমা এমনটি করোনা। তোমার হত্যা মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হবে।’
জবাবে তিনি বললেনঃ
‘খালিদ আমাকে ছেড়ে দাও। রাসুলের সা. ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে তুমি আমার থেকে অগ্রগামী। আমার পিতা ও আমি ছিলাম রাসূলুল্লাহর সা সবচেয়ে বড় শত্রু আমাকে আমার অতীতের কাফফারা আদায় করতে দাও। অনেক যুদ্ধেই আমি রাসূলুল্লাহর সা. বিরুদ্ধে লড়েছি। আর আজ আমি রোমান বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যাব? এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
একথা বলে তিনি মুসলমানদের কাছে আবেদন জানালেন, ‘মৃত্যুর ওপর বাইয়াত করতে চায় কে?’ তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিলেন তাঁর চাচা হারিস ইবন হিশাম, দিরার ইবনুল আযওয়ার ও আরো চার শ’ মুসলিম সৈনিক। তাঁরা খালিদ ইবন ওয়ালিদের তাঁবুর সম্মুখভাগ থেকেই তুমুল লড়াই চালিয়ে ইয়ারমুকের ময়দানে বিরাট বিজয় ও সম্মান বয়ে এনেছিলেন।
এই ইয়ারমুকের ময়দানেই হারিস ইবন হিশাম, আয়য়াশ ইবন আবী রাবিয়া ও ইকরিমা ইবন আবী জাহলকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। পিপাসায় কাতর হারিস ইবনে হিশাম পানি চাইলেন। যখন তাঁকে পানি দেওয়া হলো, ইকরিমা তখন তাঁর দিকে তাকালেন। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইকরিমাকে দাও।’
পানির গ্লাসটি যখন ইকরিমার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আয়য়াশ তার দিকে তাকালেন। তা দেখে ইকরিমা বললেন, ‘আয়য়াশকে দাও।’ আয়য়াশের কাছে পানির গ্লাসটি নিয়ে যাওয়া হলে দেখা গেল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তারপর গ্লাসটি হাতে নিয়ে একে একে তার অপর দুই সাথীর কাছে গিয়ে দেখা গেল তাঁরাও তারই পথের পথিক হয়েছেন। আল্লা তা’আলা তাঁদের সকলের প্রতি রাজী ও খুশী থাকুন। আমীন!
নাম ‘সুহাইব, কুনিয়াত আবু ইয়াহইয়া। পিতা সিনান, মাতা সালমা বিনতু কাঈদ। পিতা আরবের বনী নুমাইর এবং মাতা বনী তামীম খান্দানের সন্তান। তাঁকে রুমী বা রোমবাসী বলা হয়। আসলে তিনি কিন্তু রোমবাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন আরব।
রাসূলুল্লাহর (সা) নবুওয়াত প্রপ্তির আনুমানিক দ’দশক পূর্বে পারশ্য সাম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে তার পিতা সিনান ইবনে মালিক বসরার এক প্রচীন শহর ‘উবুল্লার’ শাসক ছিলেন। সুহাইব ছিলেন পিতার প্রিয়তম সন্তান। তাঁর মা সুহাইবকে সংগে করে আরো কিছু লোক লস্করসহ একবার ইরাকের ‘সানিয়্যা’ নামক পল্লীতে বেড়াতে যান। হঠাৎ এক রাতে রোমান বাহিনী অতর্কিতে পল্লীটির ওপর আক্রমন করে ব্যাপক হত্যাও লুটতরাজ চালায়। নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাস দাসীতে পরিনত করে। বন্দীদের মধ্যে শিশু সুহাইবও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স পাঁচ বছরের বেশী হবেনা.
সুহাইবকে রোমের এক দাস ক্রয়-বিক্রয়ের বাজারে বিক্রি করা হলো। তিনি এক মনিবের হাত থেকে অন্য মনিবের হাতে গেলেন ক্রমাগতভাবে। তৎকালীন রোমা সমাজে দাসদের ভাগ্যে এমনই ঘটতো। এভাবে ভেতর থেকেই রোমান সমাজের গভীরে প্রবেশ করার এবং সেই সমাজের অভ্যন্তরে সংটিত অশ্লীলতা ও পাপাচার নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তিনি লাভ করেন।
সুহাইব রোমের ভূমিতে লালিত পালিত হয়ে যৌবনে পদার্পন করেন। তিনি আরবী ভাষা ভুলে যান অথবা ভুলে যাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেন। তবে তিনি যে মরু আরবের সন্তান, এ কথাটি এক দিনের জন্যও ভুলেননি। সর্বদা তিনি প্রহর গুনতেন, কবে দাসত্বের শৃঙখল থেকে মুক্ত হবেন এবং আরবে নিজ গোত্রের সাথে মিলিত হবেন। তাঁর এ আগ্রহ প্রবলতর হয়ে ওঠে যে দিন তিনি এক খৃষ্টান কাহিনের (ভবিষ্যদ্বক্তা) মুখে শুনতে পেলনঃ ‘সে সময় সমাগত যখন জাযীরাতুল আরবের মক্কায় একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি ঈসা ইবন মরিয়মের রিসালাতকে সত্যায়িত করবেন এবং মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসবেন।’
সুহাইব সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকলেন। সুযোগ এসেও গেল। একদিন মনিবের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে মক্কায় চলে এলেন। মক্কার লোকেরা তাঁর সোনালী চুল প জিহ্বার জড়তার কারণে তাঁকে সুহাইব আর রুমী বলতে থাকে। মক্কায় তিনি বিশিষ্ট কুরাইশ নেতা আবদুল্লাহ ইবন জুদআনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁর সাথে যৌথভাবে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেন। ব্যবসায় দারুণ সাফল্য লাভ করেন। অবশ্য অন্য একটি বর্ণনা মতে আরবের বনী কালব তাঁকে খরীদ করে মক্কায় নিয়ে আসে। আবদুল্লাহ ইবন জুহআন তাদের নিকট থেকে তাঁকে খরীদ করে আযাদ করে দেন।
সুহাইব মক্কায় তাঁর কারবার ও ব্যবসা বাণিজ্যের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও এক মুহূর্তের জন্য সেই খৃষ্টান কাহিনের ভবিষ্যদ্বানীর কথা ভুলেননি। সে কথা স্মরণ হলেই মনে মনে বলতেনঃ তা কবে হবে? এ ভাবে অবশ্য তাঁকে বেশী দিন কাটতে হয়নি।
একদিন তিনি এক সফর থেকে ফিরে এসে শুনতে পেলেন, মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ নবওয়াত লাভ করেছেন। মানুষকে তিনি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য আহবান জানাচ্ছেন, তাদেরকে আদল ও ইহসানের প্রতি উৎসাহিত করছেন এবং অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন।
সুহাইব মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যাঁকে আল আমীন বলা হয় ইনি কি সেই ব্যক্তি?’ লোকেরা বললো ‘হ্যাঁ’। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর বাসস্থান কোথায়? বলা হলো, ‘সাফা পাহাড়ের কাছে আল-আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে তিনি থাকেন। তবে সর্তক থেকো কুরাইশদের কেউ যেন তোমাকে তাঁর কাছে দেখে না ফেলে। যদি তারা মুহাম্মাদের কাছে তোমাকে দেখতে পাঁয়, তোমার সাথে তেমন আচরণই তারা করবে যেমনটি তারা আমাদের সাথে করে থাকে। তুমি একজন ভিনদেশী মানুষ, তোমাকে রক্ষা করার কেউ এখানে নেই। তোমার গোত্র গোষ্ঠীও এখানে নেই।
সুহাইব চললেন দারুল আরকামের দিকে অত্যন্ত সন্তর্পনে। আরকামের বাড়ীর দরযায় পৌঁছে দেখতে পেলেল সেখানে আম্মার ইবনে ইয়াসির দাঁড়িয়ে। আগেই তাঁর সাথে পরিচয় ছিল। একটু ইতস্ততঃ করে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘আম্মার তুমি এখানে?
আম্মার পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, বরং তুমিই বল, কি জন্য এসেছ?’ সুহাইব বললেন, ‘আমি এই লোকটির কাছে যেতে চাই, তাঁর কিছু কথা শুনতে চাই।’
আম্মার বললেন, আমারও উদ্দেশ্য তাই। ‘সুহাইব বললেন, ‘তাহলে আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়ি।’
দু’জনে এক সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে পৌঁছে তাঁর কথা শুনলেন। তাঁদের অন্তর ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। দু’জনেই এক সাথে রাসূলুল্লাহ্র (সা) দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কালেমা শাহাদত পাঠ করলেন। সে দিনটি তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) সাহর্চযে থেকে তাঁর উপদেশপুর্ণ বাণী শ্রবণ করলেন।
গভীর রাতে মানুষের শোরগোল থেমে গেলে তাঁরা চুপে চুপে অন্ধকারে রাসূলুল্লাহর (সা) দরবার থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ আস্তানার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। হযরত সুহাইবের পূর্বে তিরিশেরও বেশী সাহাবী ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। তাঁদের অধিকাংশ কুরাইশদের ভয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখেছিলেন।
সুহাইব যদিও বিদেশী ছিলেন, মক্কায় তাঁর কোন আত্বীয় বন্ধু ছিল না, তা সত্বেও তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহনের কথা ঘোষণা করে দিলেন। বিলাল, আম্মার, সুমাইয়্যা, খাব্বাব প্রমুখের ন্যায় তিনিও কুরাইশদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকারে পরিণত হলেন। অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সকল নির্যাতন সহ্য করেতে থাকেন। তিনি জানতেন, জান্নাতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
রাসূলুল্লাহ (সা) যখন হিজরাতের সংকল্প করলেন, সুহাইব তা অবগত হলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তিনিই হবেন ‘সালেসু সালাসা-তিনজনের তৃতীয় জন। অর্থাৎ রাসূল (সা), আবু বুকর ও সুহাইব। কিন্তু কুরাইশদের সচেতন পাহারার কারণে তা হয়নি। কুরাইশরা তাঁর পিছু লেগে ছিল, যাতে তিনি তাঁর বিপুল ধন-সম্পদ নিয়ে মক্কা থেকে সরে যেতে না পারেন।
রাসূলুল্লাহর হিজরাতের পর সুহাইব সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। কুরাইশরাও তাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। অবশেষে তিনি এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন।
এক প্রচন্ড শীতের রাতে বার বার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাড়ীর বাইরে যেতে লাগলেন। একবার যেয়ে আসতে না আসতে আবার যেতে লাগলেন। কুরাইশ পাহারাদাররা বলা বলি করলো, লাত ও উযযা তার পেট খারাপ করেছে। তারা কিছুটা আত্মতৃপ্তি বোধ করলো এবং বাড়ীতে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এই সুযোগে সুহাইব বাড়ী থেকে বের হয়ে মদীনার পথ ধরলেন।
সুহাইব মক্কা থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যেতে না যেতেই পাহারাদাররা বিষয়টি জানে ফেলে। তারা তাড়াতাড়ি দ্রুতগতি সম্পন্ন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তাঁর পিছু ধাওয়া করে। সুহাইব তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে একটি উচু টিলার ওপর উঠে তীর ও ধনুক বের করে তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, ‘কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা জান, আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তীরন্দায ও নিশানবায ব্যক্তি। আল্লাহর কসম, আমার কাছে যতগুলি তীর আছে, তার প্রত্যেকটি দিয়ে তোমাদের এক একজন করে খতম না করা পর্যন্ত তোমরা আমার কাছে পৌঁছতে পারবে না।
তারপর আমার তরবারি তো আছেই।’ কুরাইশদের একজন বললোঃ ‘আল্লাহর কসম! তুমি জীবনও বাঁচাবে এবং অর্থ-সম্পদও নিয়ে যাবে তা আমরা হতে দেব না। তুমি মক্কায় এসেছিলে শুন্য হাতে। এখানে এসেই এসব ধন-সম্পদের মালিক হয়েছো।’
সুহাইব বললেন, ‘আমি যদি আমার ধন-সম্পদ তোমাদের হাতে তুলে দিই, তোমরা আমার রাস্তা ছেড়ে দেবে?’ তারা বললো, ‘হাঁ’।
সুহাইব তাদেরকে সংগে করে মক্কায় তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন এবং ধন-সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিলেন। কুরাইশরাও তাঁর পথ ছেড়ে দিল। এভাবে সুহাইব দ্বীনের খাতিরে সবকিছু ত্যাগ করে মদীনায় চলে এলেন। পেছনে ফেলা আসা কষ্টোপার্জিত ধন-সম্পদের জন্য তিনি একটুও কাতর হননি। পথে যখনই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, রাসূলের (সা) সাথে সাক্ষাতের কথা স্মরণ হতেই সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আবার যাত্রা শুরু করেন।
এভাবে তিনি কুবায় পৌঁছেন। রাসূল (সা) তখন কুবায় কুলসূম ইবন হিদামের বাড়ীতে। রাসূল (সা) তাঁকে আসতে দেকে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠেন, ‘আবু ইয়াহইয়া, ব্যবসা লাভজনক হয়েছে,’ তিন বার তিনি একথাটি বলেন। সুহাইবের মুখমন্ডল আনন্দে উজ্জল হয়ে ওঠে। তিনি বলে উঠেন, ‘আল্লাহর কসম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার আগে তো আপনার কাছে কেউ আসেনি। নিশ্চয় জিবরীল এ খবর আপনাকে দিয়েছে।’ সত্যিই ব্যবসাটি লাভজনকই হয়েছিল। একথার সমর্থনে জিবরীল (আ) ওহী নিয়ে হাজির হলেন, ‘ওয়া মিনন নাসে মান ইয়াশরী নাফসাহু ইবতিগা মারদাতিল্লাহ। ওয়াল্লাহু রাউফুম বিল ইবাদ’কিছু মানুষ এমনও আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের জীবনও বিক্রি করে দেয়। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।
হযরত সুহাইব মদীনায় সা’দ ইবন খুসাইমার অতিথি হন এবং হারিস ইবনুস সাম্মা আল-আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম হয়।
হযরত সুহাইব ছিলেন দক্ষ তীরন্দাসয। বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সহযাত্রী ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে জন সমাবেশে তিনি এসব যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে বর্ণনা করতেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্য সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহর (সা) প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ভুমিকায় আমি উপস্থিত থেকেছি। তিনি যখনই কোন বাইয়াত গ্রহণ করেছেন, আমি উপস্থিত থেকেছি। তাঁর ছোট ছোট অভিযান গুলিতে অংশগ্রহণ করেছি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যত যুদ্ধ তিনি করেছেন তার প্রত্যেকটিতে আমি তাঁর ডানে অথবা বামে অবস্থান করে যুদ্ধ করেছি।
মুসলমানরা যতবার এবং যেখানেই পেছনের অথবা সামনের শত্রুর ভয়ে ভীত হয়েছে, আমি সব সময় তাদের সাথে থেকেছি। রাসূলুল্লাহকে (সা) কক্ষনো আমরা নিজের ও শত্রুর মাঝখানে হতে দিইনি। এভাবে রাসূল (সা) তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন।’(রিজালুন হাওলার রাসূল-১৩০)
হযরত সুহাইব সম্পর্কে হযরত ‘উমারের (রা) অত্যন্ত সুধারণা ছিল। তিনি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মৃত্যর পুর্বে তিনি অসীয়াত করে যান, সুহাইব তাঁর জানাযার ইমামতি করবেন। শুরার সদস্যবৃন্দ যতক্ষণ নতুন খলিফার নাম ঘোষণা না করবেন, তিনিই খিলাফতের দায়িত্ব পালন করতে থাকবেন। হযরত উমারের (রা) মৃত্যুর পর তিন দিন পযর্ন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন।
হিজরী ৩৮ সনে ৭২ বছর বয়সে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন। মদীনার ‘বাকী’ গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়।
হযরত সুহাইব (রা) জীবনের বিরাট এক অংশ রাসূলে পাকের সাহচার্যে কাটানোর সুযোগ লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেনঃ ওহী নাযিলের পূর্ব থেকেই রাসূলুল্লাহর (সা) সুহবত লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’ একারণে সকল সৎগুনাবলীর সমাবেশ তাঁর মধ্যে ঘটেছিল। সচ্চরিত্রতা, আত্ম মর্যাদা বোধের সাথে সাথে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, হাস্য কৌতুক ইত্যাদি গুণাবলী তাঁর চরিত্রকে আরও মাধুর্য্য দান করেছিল।
তিনি ছিলেন অতিথি পরায়ণ ও দানশীল। গরিব দুঃখীর প্রতি ছিলেন দরাযহস্ত। মাঝে মাঝে মানুষের ধারণা হতো, তিনি দারুণ অমিতব্যয়ী। একবার হযরত উমার (রা) তাঁকে বলেন, তোমার কথা আমার ভালো লাগে না। কারণ, ‘প্রথমতঃ তোমার কুনিয়াত আবু ইয়াহইয়া। এই নামে একজন নবী ছিলেন। আর এ নামে তোমার কোন সন্তান নেই। দ্বিতীয়তঃ তুমি বড় অমিতব্যয়ী।
তৃতীয়তঃ তুমি নিজেকে একজন আরব বলে দাবী কর।’জবাবে তিনি বলেন, ‘এই কুনিয়াত আমি নিজে গ্রহণ করিনি। রাসুলুল্লাহর (সা) নির্বাচিত। দ্বিতীয়তঃ অমিতব্য্যিতা। তা আমার একাজের ভিত্তি হলো, রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণী-‘ যারা মানুষকে অন্নদান করে এবং সালামের জবাব দেয় তারাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। তৃতীয় অভিযোগটির জবাব হলো, প্রকৃতই আমি একজন আরব সন্তান। শৈশবে রোমবাসী আমাকে লুট করে নিয়ে যায়, আমাকে আমার গোত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাসে পরিণত করে, এ-কারণে আমি আমার গোত্র ও খান্দানকে ভুলে যাই।’
হযরত সুহাইবের দৈহিক গঠন ছিল মধ্যমাকৃতির। না লম্বা না খাটো। চেহরা উজ্জ্বল, মাথার চুল ঘন। বার্ধক্যে মেহেন্দীর খিযাব লাগাতেন। জিহবায় কিছুটা জড়তা ও তোৎলামী ছিল। একবার তাঁর চাকর ইয়াহনাসকে ডাকছিলেন। তা যেন শুনা যাচ্ছিল, ‘নাস’। নাস অর্থ মানুষ। হযরত উমার সে ডাক শুনে বলে ওঠেন, ‘লোকটি এভাবে ‘নাস’ ‘অর্থাৎ মানুষকে ডাকছে কেন?’ হযরত উম্মে সালামা (রা) বললেন, ‘সে নাস’ দ্বারা মানুষ কে নয়, বরং তার চাকর ইয়াহনাসকে ডাকছে। জিহবার জড়তার দরুণ নামটি ভালো মত উচ্চারণ করতে পারে না।
হযরত রাসূলে কারীম(সা) একদিন সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা কুরআন শেখ চার ব্যক্তির নিকট থেকেঃ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, সালেম মাওলা আবী হুজাইফা, উবাই ইবনে কা’ব ও মুয়ায ইবনে জাবাল।” কে এই সালেম মাওলা আবী হুজাইফা- যাকে কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ(সা) নির্ভরযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন?
তাঁর নাম সালেম, কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ। পিতার নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইবন মুন্দাহ বলেছেন, ‘উবায়েদ ইবনে রাবী’য়া। আবার কারো কারো মতে, মা’কাল। ইরানী বংশোদ্ভূত। পারস্যের ইসতাখরান তাঁর পূর্বপুরুষের আবাসভূমি। হযরত সুবাইতা বিনতু ইউ’য়ার আল আনসারিয়্যার দাস হিসেবে মদীনায় পৌছেন।
হযরত সুবাইতা ছিলেন আবী হুজাইফার(রা) স্ত্রী। সুবাইতা তাকে নিঃশর্ত আযাদ করে দিলে আবু হুজাইফা তাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি সালেম ইবনে আবু হুজাইফা নামে পরিচিত হন যেমন হয়েছিলেন যায়িদ ইবনে মুহাম্মাদ। কেউ কেউ তাঁকে আবু হুজাইফার দাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এসব কারণে তাঁকে মুহাজিরদের মধ্যে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে হযরত সুবাইতার আযাদকৃত দাস হিসেবে তাঁকে আনসারীও বলা হয়। আবার মূলে পারস্যের সন্তান হওয়ার কারণে কেউ কেউ তাঁকে আজমী বা অনারব বলেও উল্লেখ করেছেন।
হযরত সালেম মক্কায় হযরত আবু হুজাইফার সাথে বসবাস করতেন। এই আবু হুজাইফা ছিলেন মক্কার কুরাইশ সর্দার ইসলামের চির দুশমন উতবা’র ছেলে। ইসলামী দাওয়াতের সূচনালগ্নেই যারা লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আবু হুজাইফা ও তাঁর পালিত পুত্র সালেম ও ছিলেন। তাঁরা পিতা-পুত্র দুজনে নীরবে ও বিনীতভাবে তাঁদের রবের ইবাদত করে চললেন এবং কুরাইশদের নির্মম অত্যাচারের মুখে সীমাহীন ধৈর্য্য অবলম্বন করলেন।
একদিন পালিতপূত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করে কুরআনের আয়াত নাযিল হলো-‘উদয়ুহুম লি আবায়িহিম’-তাদেরকে তাদের পিতার নামে সম্পৃক্ত করে ডাক। প্রত্যেক পালিত পুত্র আপন আপন জন্মদাতা পিতার নামে পরিচিতি গ্রহণ করলো। যেমন যায়িদ ইবনে মুহাম্মদ হলো যায়িদ ইবনে হারিসা। কিন্তু সালেম এর পিতৃপরিচয় ছিল অজ্ঞাত। তাই তিনি পরিচিত হলেন ‘সালেম মাওলা আবী হুজাইফা’-আবু হুজাইফার বন্ধু, সাথী, ভাই বা আযাদকৃত দাস সালেম হিসেবে।
ইসলাম পালিত পুত্রের প্রথা বাতিল করে। সম্ভবত ইসলাম একথা বলতে চায় যে, রক্ত, আত্মীয়তা বা অন্য কোনো সম্পর্ককে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া তোমাদের উচিত নয়। বিশ্বাস বা আকীদার ভিত্তিতেই তোমাদের সম্পর্ক নির্মিত হওয়া উচিত। প্রথম পর্যায়ের মুসলমানরা এ ভাবটি খুব ভাল করে বুঝেছিলেন। তাই, তাঁদের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পর তাঁদের দ্বীনি ভাই অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কিছু ছিল না। এটা আমরা আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে দেখেছি। তেমনিভাবে দেখে থাকি সম্ভ্রান্ত কুরাইশ আবু হুজাইফা ও তাঁর পিতৃ পরিচয়হীন অজ্ঞাত অখ্যাত দাস সালেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
হযরত সালেমের ঈমান ছিল সিদ্দীকিনদের ঈমানের মত এবং আল্লাহর পথে তিনি চলেছিলেন মুত্তাকীনদের মত। সমাজে তাঁর স্থান কি এবং তাঁর জন্ম-পরিচয়ই বা কি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেন নি। ইসলাম যে নতুন সমাজ বিনির্মাণ করেছিল, সেই সমাজ তাঁর তাকওয়া ও ইখলাসের জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
এই মহান পূণ্যময় নতুন সমাজেই আবু হুজাইফা-গতকাল যে তাঁর দাস ছিল তাকে ভাই বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করে গৌরব বোধ করেছিলেন। এমনকি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ফাতিমা বিনতুল ওয়ালিদকে তাঁর সাথে বিয়ে দিয়ে নিজ পরিবারকে সম্মান ও গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যে সমাজ ব্যবস্থা সকল প্রকার যুলুম অত্যাচার দূর করে সব রকম মিথ্যা আভিজাত্যকে বাতিল ঘোষণা করেছিল, সেখানে সালেমের ঈমান, সততা ও দৃঢ়তা তাঁকে প্রথম সারির ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
হযরত রাসূলে কারীমের হিজরতের পূর্বেই তিনি তাঁর দ্বীনি বন্ধু আবু হুজাইফার সাথে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় তিনি হজরত আব্বাদ ইবনে বিশরের অতিথি হন। মক্কায় রাসূলুল্লাহ(সা) আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহর সাথে তাঁর দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব কায়েম করে দেন। কিন্তু মদীনায় তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় হযরত মুয়াজ ইবনু মায়েজ আল আনসারীর সাথে।
সাহাবীদের যুগে কিরআত শিল্পে যাদেরকে ইমাম গণ্য করা হতো, সালেম তাঁদের অন্যতম। তিনি এমন সুমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলে শ্রোতারা তা মুগ্ধ হয়ে শুনত। একদিন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশার রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট হাজির হতে দেরি হল।
রাসূলুল্লাহ(সা) জিজ্ঞেস করলেন- তোমার দেরি হল কেন? আয়িশা বললেন- একজন কারী সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করছিল, তাই শুনছিলাম। তিনি তাঁর তিলাওয়াতের মাধূর্য্য বর্ণনা করলেন। তাঁর বর্ণনা শুনে রাসূলুল্লাহ(সা) চাদরটি টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, সেই ক্বারী আর কেউ নয়, তিনি সালেম মাওলা আবু হুজাইফা। রাসূলুল্লাহ(সা)তাঁর তিলাওয়াত শুনে মন্তব্য করলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাজী জা’য়ালা ফী উম্মাতী মিছলাক”-আমার উম্মাতের মধ্যে যিনি তোমার মত লোককে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। (উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
সুমধুর কন্ঠস্বর এবং বেশি কুরআন হিফজ থাকার কারণে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে সালেমকে অত্যধিক সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হতো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ(সা) মদীনায় হিজরতের পূর্বে যারা মদীনায় হিজরত করেছিলেন, মসজিদে কুবায় সালেম তাদের নামাজে ইমামতি করতেন।” (বুখারী) হযরত আবু বাকর ও হযরত উমারের(রা) মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও তাঁর পেছনে নামায আদায় করতেন।
বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই তিনি রাসূলে কারীমের(সা) সাথে ছিলেন।(উসুদুল গাবা-২/২৪৬) বদর যুদ্ধে তিনি কাফের উমাইর ইবন আবী উমাইরকে নিজ হাতে হত্যা করেন। (ইবন হিশাম-১/৭০৮)।
মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ(সা) মক্কার চারিদিকের গ্রাম ও গোত্রগুলিতে কতকগুলি দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠালেন। তিনি তাদেরকে বলে দিলেন, “যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং দায়ী বা আহবানকারী হিসেবে তোমাদের পাঠানো হচ্ছে।” এমন একটি দলের নেতা ছিলেন হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালীদ। খালীদ তাঁর গন্তব্যস্থানে পৌছার পর এমন এক ঘটনা ঘটলো যে, তিনি তরবারী চালালেন এবং তাতে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো।
এ খবর রাসূলুল্লাহ(সা) এর কানে পৌছলে তিনি দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর কাছে এই বলে ওজর পেশ করলেন-“হে আল্লাহ, খালিদ যা করেছে, তার দায় দায়িত্ব থেকে আমি তোমার কাছে অব্যাহতি চাই।” এ অভিযানে হযরত সালেম হযরত খালিদের সহগামী ছিলেন। খালিদের এ কাজ সালেম নীরবে মেনে নেন নি। তিনি খালিদের এ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের মুখে মহাবীর খালিদ কখনো লা-জওয়াব হয়ে যান, আবার কখনও আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। আবার কখনও সালেম এর সাথে প্রচন্ড বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সালেম স্বীয় মতের উপর অটল থাকেন। খালিদের ভয়ে সেদিন তিনি সত্য বলা হতে চুপ থাকেন নি।
সালেম কদিন আগেও যিনি ছিলেন মক্কার এক দাস, আজ তিনি খালিদের মত মক্কার এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ সিপাহশালারের কোনো পরোয়াই করেন নি। খালিদও কোনোপ্রকার বিরক্তিবোধ করেন নি। কারণ, ইসলাম তাঁদের উভয়কে সমমর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নেতার প্রতি অহেতুক ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সালেম সেদিন খালিদ এর ভুল মেনে নেননি। বরং তিনি দায়িত্বের অংশীদার হিসেবে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন। তিনি আত্মতৃপ্তি বা নামের জন্য এ কাজ করেন নি বরং বারংবার তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে শুনেছিলেন, “আদ-দ্বীন আন নাসীহা”- দ্বীনের অপর নাম সতোপদেশ। এ উপদেশই সেদিন তিনি খালিদকে দান করেছিলেন।
হযরত খালিদের এ বাড়াবাড়ির কথা রাসূলুল্লাহ(সা) এর কানে পৌছলে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- “কেউ কি তার এ কাজের প্রতিবাদ বা নিন্দে করে নি?” রাসূলে পাকের ক্রোধ পরে গেল যখন তিনি শুনলেন, “হ্যাঁ, সালেম প্রতিবাদ করেছিল। তাঁর সাথে ঝগড়া হয়েছিল।”
হযরত রাসূলে কারীম(সা) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরের খিলাফত মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলো। তাদের সাথে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ইয়ামামার যুদ্ধ। এমন ভয়াবহ যুদ্ধ ইতোপূর্বে ইসলামের ইতিহাসে আর সংঘটিত হয় নি। মুসলিম বাহিনী মদীনা হতে ইয়ামামার উদ্দেশ্যে বের হলো।
সালেম এবং তাঁর দ্বীনি ভাই আবু হুজাইফা অন্যদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। যুদ্ধের প্রথম পর্বে মুসলিম বাহিনী কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তাঁরা বুঝতে পারে, যুদ্ধ যুদ্ধই এবং দায়িত্ব দায়িত্বই। হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ নতুন করে তাদের সংগঠিত করেন এবং অভূতপূর্ব কায়দায় তিনি বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। প্রথমতঃ যখন মুসলিম বাহিনী পিছু হটে যাচ্ছিল, তখন হযরত সালেম চিৎকার করে উঠলেন, “আফসুস, রাসূলুল্লাহ(সা) এর সময়ে আমাদের অবস্থা তো এমন ছিল না।” তিনি নিজের জন্য একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে যান।(উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
ইয়ামামার যুদ্ধে প্রথমে হযরত যায়িদ ইবনুল খাত্তাবের হাতে ছিল মুসলিম বাহিনীর পতাকা। তিনি শাহাদাত বরণ করলে পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সালেম তা তুলে ধরেন। কেউ কেউ তাঁর পতাকা বহনে আপত্তি করে বলে, “আমরা তোমার দিক থেকে শত্রুবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করছি।” সালেম বলেন, “তাহলে তো আমি হয়ে যাব কুরআনের এক নিকৃষ্ট বাহক।”(হায়াতুস সাহাবা-১/৫৩৫)।
শত্রু বাহিনীকে আক্রমণের পূর্বে দুই দ্বীনি ভাই-আবু হুজাইফা ও সালেম পরস্পর বুক মেলালেন এবং দ্বীনে হকের পথে শহীদ হওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। তারপর উভয়ে শত্রুবাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আবু হুজাইফা একদিকে চিৎকার করে বলছেন, “ওহে কুরআনের ধারকরা, তোমরা তোমাদের আমল দ্বারা কুরআনকে সজ্জিত কর।” আর অন্যদিকে মুসাইলামা কাজ্জাবের বাহিনীর উপর তরবারির আঘাত হানছেন। আর একদিকে সালেম চিৎকার করে বলছেন, “আমি হব কুরআনের নিকৃষ্ট বাহক-যদি আমার দিক হতে শত্রুবাহিনীর আক্রমণ আসে।” মুখে তিনি একথা বলছেন আর দুহাতে তরবারী শত্রু সৈন্যের গর্দানে মারছেন।
এক ধর্মত্যাগীর অসির তীব্র আঘাত তাঁর ডান হাতে পড়লো। হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি বাম হাতে পতাকাটি উঁচু করে ধরেন। বাম হাতটিও শত্রুর আঘাতে কেটে পড়ে গেলে পতাকাটি গলার সাথে পেঁচিয়ে ধরেন। এ অবস্থায় তিনি উচ্চারণ করতে থাকেন কুরআনের এ আয়াত, “ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, ওয়াকা আইয়্যিন মিন নাবিয়্যিন কা-তালা মা’য়াহু রিব্বিয়ূনা কাসীর।”….“মুহাম্মাদুর আল্লাহর এক রাসূল ছাড়া আর কিছু নন।
অতীতে কত নবীর সহযোগী হয়ে কত আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিই না যুদ্ধ করেছে। আল্লাহর পথে তাদের উপর যে বিপদ মুসীবত আপতিত হয়েছে, তাতে তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েনি এবং থেমেও যায়নি। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের ভালবাসেন।” এই ছিল তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তের শ্লোগান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরতাদদের একটি দল সালেমকে ঘিরে ফেলে। মহাবীর সালেম লুটিয়ে পড়েন। তখনও তাঁর দেহে জীবনের স্পন্দন অবশিষ্ট ছিল। মুসাইলামা কাজ্জাবের নিহত হওয়ার সাথে মুসলমানদের বিজয় ও মুরতাদদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মুসলমানরা আহত নিহতদের খোঁজ করতে লাগলো। সালেমকে তাঁরা জীবনের শেষ অবস্থায় খুঁজে পেল। এ অবস্থায় সালেম তাঁদের জিজ্ঞেস করেন- আবু হুজাইফার অবস্থা কি?
-সে শাহাদাত বরণ করেছে।
-যে ব্যক্তি আমার দিক হতে শত্রু বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করেছিল তাঁর অবস্থা কি?
-শহীদ হয়েছে।
-আমাকে তাঁদের মাঝখানেই শুইয়ে দাও।
-তাঁরা দুজন তোমার দুপাশেই শহীদ হয়েছে।
হযরত সালেম শেষবারের মত শুধু একটু মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। আর কোনো কথা বলেন নি। সালেম এবং আবু হুজাইফা উভয়ে যা আন্তরিকভাবে কামনা করেছিলেন, লাভ করেন। তাঁরা একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেন, একসাথে জীবন যাপন করেন এবং একসাথে একস্থানে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত সালেমের কাহিনী বিলাল ও অন্যান্য অসংখ্য অসহায় দাসদের কাহিনীর মতই। ইসলাম তাঁদের সকলের কাঁধ হতে দাসত্বের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাঁদেরকে সত্য ও কল্যাণময় সমাজে ইমাম, নেতা ও পরিচালকের আসনে বসিয়ে দেয়। তাঁর মধ্যে মহান ইসলামের যাবতীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি যা সত্য বলে জানতেন অকপটে তা প্রকাশ করে দিতেন, তা বলা হতে কক্ষনো বিরত থাকতেন না। তাঁর মুমিন বন্ধুরা তাঁর নাম রেখেছিল-‘সালেম মিনাস সালেহীন’-সত্যনিষ্ঠদের দলভুক্ত সালেম।
হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) সালেমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছিলেন, “আজ সালেম জীবিত থাকলে শুরার পরামর্শ ছাড়াই আমি তাঁকে খিলাফতের দায়িত্ব দিতাম।”(উসুদুল গাবা-২/২৪৬)।
হযরত সালেম ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মৃত্যুর পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে ওসীয়ত করে যান। এক তৃতীয়াংশ দাসমুক্তি ও অন্যান্য ইসলামী কাজের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ পূর্বতন মনিব হযরত সুবাইতার অনুকূলে। হযরত আবু বাকর(রা) অসীয়ত মত এক তৃতীয়াংশ সুবাইতার কাছে পাঠালে তিনি এই বলে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান যে, আমি তো তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছি, বিনিময়ে কোনো কিছু আশা করিনি। পরে খলীফা উমার(রা) তা বায়তুল মালে জমা দেন।(আল ইসতিয়াব, উসুদুল গাবা-২/২৪৭)।
হযরত সালেম থেকে রাসূলুল্লাহর(সা) হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবার অনেক সাহাবী তাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ঐতিহাসিকরা বলেন, ‘হযরত আসমা রা. একশ’ বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটি দাঁতও পড়েনি বা তাঁর সামান্য বুদ্ধিভ্রষ্টতাও দেখা যায়নি।’
এ মহিলা সাহাবী সর্বদিক দিয়েই সমমান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্নি, স্বামী ও পুত্র সকলেই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী। একজন মুসলমানের এর চাইতে বেশী সম্মান, মর্যাদা, ও গৌরবের বিষয় কি হতে পারে?
পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালের বন্ধু, ওফাতের পর তাঁর প্রথম খলীফা। মাতা কুতাইলা বিনতু আবদিল ’উয্যা। পিতামহ হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা বা আবু আতীক। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা রা. তাঁর বোন। রাসূলুল্লাহর সা. হাওয়ারী বিশেষ সাহায্যকারী যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. তাঁর স্বামী ও সত্য এবং ন্যায়ের পথে শহীদ হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর পুত্র। এ হলো হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। হিজরাতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথম যুগেই যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, আসমা রা. তাঁদেরই একজন। মাত্র সতেরো জন নারী পুরুষ ব্যতীত আর কেউ তাঁর আগে এ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। তাঁকে ‘জাতুন নিতাকাইন’- দু’টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হয়। কারণ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় তিনি রাসূল সা. ও তাঁর পিতার জন্য থলিতে পাথেয় ও মশকে পানি গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ বাঁধার জন্য ধারে কোন রশি খুঁজে পেলেন না।
অবশেষে নিজের কোমরের নিতাক বা বন্ধনী খুলে দু’টুকরো করে একটা দ্বারা থলি ও অন্যটি দ্বারা মশকের মুখ বেঁধে দেন, এ দেখে রাসুল সা. তাঁর জন্য দু’আ করেনঃ আল্লাহ যেন এর বিনিময়ে জান্নাতে তাঁকে দু’টি ‘নিতাক’ দান করেন। এভাবে তিনি ‘জাতুন নিতাকাইন’ উপাধি লাভ করেন।
যুবাইর ইবনুল আওয়ামের সাথে যে সময় তার বিয়ে হয় তখন যুবাইর অত্যন্ত দরিদ্র ও রিক্তহস্ত। তাঁর কোন চাকর-বাকর ছিলনা এবং একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোন সম্পদও ছিলনা। তবে যুবাইর একজন পূর্ণবতী ও সৎকর্মশীলা স্ত্রী লাভ করেছিলেন। তিনি স্বামীর সেবা করতেন, নিজ হাতে তাঁর ঘোড়াটির জন্য ভুষি পিষতেন ও তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে প্রাচুর্য দান করেন এবং তাঁরা অন্যতম ধনী সাহাবী পরিবার হিসাবে পরিগণিত হন।
হযরত আসমা রা. বর্ণনা করেছেন। যুবাইর রা. যখন আমাকে বিয়ে করেন তখন একটি ঘোড়া ছাড়া তাঁর আর কিছু ছিলনা। ঘোড়াটি আমিই চরাতাম ও ভূষি খাওয়াতাম। খেজুরের আটি পিষে ভূষি বানাতাম। আমি যুবাইরের ক্ষেত থেকে- যে ক্ষেত রাসুল সা. তাঁকে দিয়েছিলেন মাথায় করে খেজুরের আটি নিয়ে আসতাম। ক্ষেতটি ছিল পৌনে এক ফারসাখ দূরে। একদিন আমি খেজুরের আটি মাথায় করে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দেখা।
তাঁর সাথে তখন আরও কয়েকজন লোক ছিল। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং তাঁর বাহনের পিঠে উঠে বসার জন্য বললেন। কিন্তু আমি লজ্জা পেলাম এবং যুবাইর ও তার মান-মর্যাদার কথা মনে করলাম। রাসূল সা. চলে গেলেন। বাড়ী ফিরে আমি এ ঘটনার কথা যুবাইরকে বললাম। এরপর পিতা আবু বকর রা. আমার জন্য একটি চাকর দেন। সে-ই তখন ঘোড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে যেন আমাকে মুক্তি দিল। (সিয়ারু আ’লাম আন নুবালা- ২/২৯০-২৯১, তাবাকাত- ৮/২৫০, মুসনাদে আহমাদ- ৬/৩৪৭,৩৫২)
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় ঘনিয়ে এলো। তিনি তখন পূর্ণ অন্তঃসত্তা, আবদুল্লাহ তাঁর গর্ভে। তা সত্ত্বেও এ কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণে ভয় পেলেন না, আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়লেন। কুবা পৌঁছার পরই তিনি প্রসব করেন আবদুল্লাহকে। এ আবদুল্লাহ ছিলেন মদীনার মুহাজিরদের গৃহে, মদীনায় আসার পর জন্মগ্রহণকারী প্রথম সন্তান।
এ কারণে মুসলমানরা তাঁর জন্মের খবর শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে। তাঁর মা আসমা সদ্য প্রসূত সন্তানটিকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর কোলে তুলে দেন। রাসুল সা. নিজের জিহ্বা থেকে কিছু থু থু নিয়ে শিশুটির মুখে দেন এবং তার জন্য দু’আ করেন। তাই পার্থিব কোন জিনিস তার পেটে প্রবেশ করার পূর্বে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র থু থু তার পেটে প্রবেশ করেছিল।
হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের মধ্যে সততা, দানশীলতা, মহত্ব ও প্রখর বুদ্ধি মত্তার মত এমন সব সুষম চারিত্রিক গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল যা ছিল বিরল। তাঁর দানশীলতা তো একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি আমার মা আসমা ও খালা আয়িশা থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তবে তাঁদের দু’জনের দান প্রকৃতির মধ্যে প্রভেদ ছিল।
আমার খালার স্বভাব ছিল প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট পরিমাণে জমা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই গরীব মিসকীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মার স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।’
আসমা রা. ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী। তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন সংকটের সময়ে। ইবন হিশামের বর্ণনা থেকে জানান যায়, রাসূল সা. ও আবু বকরের হিজরাতের খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়লে পরদিন আবু জাহল ও আরো কতিপয় কুরাইশ নেতা আবু বকরের বাড়ীতে আসে এবং আসমাকে সামনে পেয়ে তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বাবা আবু বকর কোথায়?’ আসমা বলতে অস্বীকৃতি জানালে নরাধম আবু জাহল তাঁর গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ফলে তাঁর কানের দুল দু’টি ছিটকে পড়ে যায়।
হিজরাতের সময় রাসূল সা. ও আবু বকরের রা. সাওর পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে রাতের অন্ধকারে আসমা তাঁদের জন্য খাবার ও পানীয় নিয়ে যেতেন।
তাঁর পিতা আবু বকর রা. হিজরাতের সময় যাবতীয় নগদ অর্থ সাথে নিয়ে যান। দাদা আবু কুহাফা তা জানতে পেরে বলেন, ‘সে জান ও মাল উভয় ধরণের কষ্ট দিয়ে গেল।’ আসমা দাদাকে বললেন, ‘না, তিনি অনেক সম্পদ রেখে গেছেন।’ একথা বলে আবু বকর রা. যেখানে অর্থ-সম্পদ রাখতেন সেখানে অনেক পাথর রেখে দিলেন। তারপর আবু কুহাফাকে ডেকে এসে বললেনঃ ‘দেখুন, এসব রেখে গেছেন।’ আবু কুহাফা অন্ধ ছিলেন। তিনি আসমার কথায় বিশ্বাস করেন। আসমা বলেনঃ ‘আবু কুহাফাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি এমনটি করেছিলাম। আসলে সেখানে কিছুই ছিল না।’
আসমা বিনতু আবু বকরের ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। তবে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর সাথে জীবনের শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক বল ও ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দেন, ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হিজায, মিসর, ইরাক ও খুরাসানসহ সিরিয়ার বেশীর ভাগ অঞ্চলের লোকেরা আবদুল্লাহকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু উমাইয়া রাজবংশ তা মেনে নিতে পারেননি। তারা তাঁকে দমনের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে বিরাট এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠায়।
দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, এবং তাতে আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পরিশেষে তাঁর সংগী সাথীরা বিজয়ের কোন সম্ভাবনা না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তের অনুসারীদের নিয়ে কা’বার হারাম শরীফে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে উমাইয়া সেনাবাহিনীর সাথে চূড়ান্ত সংঘর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি তার মা আসমার সাথে শেষবারের মত সাক্ষাত করতে যান। হযরত আসমা রা. তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। মাতা-পুত্রের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপঃ
– মা, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্ভ
– আবদুল্লাহ, ওয়া আলাইকাস সালাম। হাজ্জাজ-বাহিনীর মিনজানিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার বাহিনীর ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে, মক্কার বাড়ী-ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে, এমন চরম মুহূর্তে তোমার উপস্থিতি কি উদ্দেশ্যে?
– উদ্দেশ্য আমাদের সাথে পরামর্শ।
– পরামর্শ! কি বিষয়ে?
– হাজ্জাজের ভয়ে অথবা তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে লোকেরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এমনকি আমার সন্তান এবং আমার পরিবারের লোকেরাও আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন আমার সাথে অল্প কিছু লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহসিকতা যত বেশীই হোকনা কেন, দু’ এক ঘন্টার বেশী তারা কোন মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়ারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে খলীফা বলে স্বীকার করে নেই এবং অস্ত্র ফেলে দিয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হই তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইবো তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন। আসমা রা. একটু উচ্চস্বরে বলেনঃ
– ব্যাপারটি একান্তই তোমার নিজস্ব। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশী জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের ওপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকেই আহ্বান করছো, তাহলে তোমার পতাকাতলে যারা অটল থেকে শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের মত তুমিও অটল থাকো। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদেরকে ধ্বংস করেছো।
– তাহলে আজ আমি নিশ্চিতভাবে নিহত হবো।
– স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং বনী উমাইয়াদের ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়াই উত্তম।
– আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার হাত-পা কেটে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।
– নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জবেহ করা ছাগলের চামড়া তোলার সময় সে কষ্ট পায় না?
একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরো কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবলমাত্র এ কথাগুলি শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভীত হননি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি, তা কোন জাগতিক সুখ সম্পদ ও মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণে নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষনা করার প্রতি আমার ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবকিছুই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।’
– যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়ের ওপর নিহত হও তাহলে আমি ব্যথিত হবো।
– আম্মা, আপনি বিশ্বাস রাখুন, আপনার এ সন্তান কখনও অন্যায় অশ্লীল কাজ করেনি, আল্লাহর আইন লংঘন করেনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কোন মুসলমান বা জিম্মীর ওপর যুলুম করেনি এবং আল্লাহর রিজামন্দী অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কোন কিছু এ দুনিয়ায় তার কাছে নেই। এ কথা দ্বারা নিজেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমার সম্পর্কে আল্লাহই বেশী ভালো জানেন। আপনার অন্তরে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি হোক- কথাগুলি শুধু এ জন্যই বলছি। জবাবে আসমা রা. বললেনঃ
– আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী জা’আলাকা আলা মা ইউহিব্বু ওয়া উহিব্বু- সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর ও আমার পছন্দনীয় কাজের ওপর তোমাকে অটল রেখেছেন। বৎস! তুমি আমার কাছে একটু এগিয়ে এসো, আমি শেষবারের মত একটু তোমার শরীরের গন্ধ শুকি এবং তোমাকে একটু স্পর্শ করি। কারণ, এটাই আমার ও তোমার ইহজীবনের শেষ সাক্ষাৎ।
আবদুল্লাহ উপুড় হয়ে তাঁর মার হাত-পা চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে লাগলেন, আর মা তার ছেলের মাথা, মুখ ও কাঁধে নিজের নাক ও মুখ ঠেকিয়ে শুকতে ও চুমু দিতে লাগলেন এবং তাঁর শরীরে নিজের দু’টি হাতের পরশ বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি একথা বলতে বলতে তাঁকে ছেড়ে দিলেনঃ
– আবদুল্লাহ তুমি এ কী পরেছো?
– আম্মা, এ তো আমার বর্ম।
– বেটা, যারা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষী এটা তাদের পোশাক নয়।
– আপনাকে খুশী করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এ পোশাক পরেছি।
– তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহসিকতা ও আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এমনটিই। তাছাড়া এটা হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার পক্ষেও সহজতর। এ পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।
মায়ের কথামত আবদুল্লাহ তাঁর বর্ম খুলে পাজামা পরলেন এবং এ কথা বলতে বলতে হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন- ‘আম্মা, আমার জন্য দু’আ করতে ভুলবেন না।’
সাথে সাথে তাঁর মা হযরত আসমা রা. দু’টি হাত আকাশের দিকে তুলে দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ, রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন তার জেগে জেগে দীর্ঘ ইবাদত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, রোযা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, পিতামাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষন করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই কাছে সোপর্দ করেছি, তার জন্য আপনি যে ফায়সালা করবেন তাতেই আমি রাজী, এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।’
সেদিন সূর্য অস্ত যাবার আগেই হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর মহাপ্রভুর সাতে মিলিত হন। তাঁর শাহাদাতের কিছুদিনের মধ্যেই হিজরী ৭৩ সনে হযরত আসমাও রা. ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল এক শ’ বছর। মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা- ২/২৮৮)
হযরত আবদুল্লাহকে রা. হত্যার পর হাজ্জাজ তাঁর লাশকে শূলিতে লটকিয়ে রেখেছিল। তাঁর মা আসমা এলেন ছেলের লাশ দেখতে । লটকানো লাশের কাছে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, ‘এ সওয়ারীর এখনো ঘোড়া থেকে নামার সময় হলো না?’ জনতার ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে নেওয়ার জন্য হাজ্জাজ লোক পাঠায়। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানান। সে আবারো লোক মারফত বলে পাঠায়, এবার না এলে, তাঁর চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হবে। হযরত আসমা হাজ্জাজের ভয়ে ভীত হলেন না। তিনি গেলেন না। এবার হাজ্জাজ নিজেই এলো। তাদের দু’জনের মধ্যে নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো। হাজ্জাজ বললোঃ
– ‘বলুন তো আমি আল্লাহর দুশমন ইবন যুবায়েরের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি?’ আসমা বললেন, ‘তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো। আর সে তোমার পরকাল নষ্ট করেছে। আমি শুনেছি, তুমি নাকি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ তনয় বলে ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’।
আমি একটি নিতাক দিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. ও আবু বকরের রা. খাবার বেঁধেছি। আরেকটি নিতাক আমার কোমরেই আছে। মনে রেখ, নবী করীমের সা. কাছ থেকে আমি শুনেছি, সাকীফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন যালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদীকে তো আগেই দেখেছি। (আল-মুখতার) আর যালিম তুমিই।’ হাজ্জাজ এ হাদীস শুনে নীরব হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিমঃ ২য় খণ্ড)।
হযরত আসমা থেকে ৫৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তেরোটি মুত্তাফাক আলাইহি এবং বুখারী পাঁচটি ও মুসলিম চারটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বহু বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ তাঁর দুই ছেলে- আবদুল্লাহ ও ’উরওয়া, পৌত্র আবদুল্লাহ ইবনে ’উরওয়া, প্রপৌত্র ’উব্বাদ ইবন আবদিল্লাহ, ইবন আব্বাস, আবু ওয়াকিদ আল-লাইসী, সাফিয়্যা বিনতু শায়বা, মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির, ওয়াহাব ইবন কায়সান, আবূ নাওফিল মুয়াবিলা ইবন আবী আকবার, আল-মুত্তালিব ইবন আবদুল্লাহ ইবন হানতাব, ফাতিমা বিনতুল মুনজির ইবনুয যুবাইর, ইবন আবী মুলাইকা, ’উব্বাদ ইবন হামযা ইবন আবদুল্লাহ এবং আরও অনেকে। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা ২/২৮৮)
নাম উসমান, কুনিয়াত আবু সায়িব। পিতা মাজউন, মাতা সুখাইলা বিনতু উনাইস। জাহিলী যুগেও তিনি অত্যন্ত পূতঃ পবিত্র স্বভাব-প্রকৃতির অধিকারী ছিলেন। স যুগের বিপুল সংখ্যক লোক মদ পানে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা একবারও স্পর্শ করেননি। যারা মদপান করতো, তাদেরকে তিনি বলতেন, এমন জিনিস পান করে কী লাভ যাতে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়, নীচ শ্রেণীর লোকের হাসির পাত্রে অরিণত হতে হয় এবং নেশা অবস্থায় মা-বোনের কোন বাছ-বিচার থাকেনা?
তাঁর অন্তরটিও ছিল দারুণ স্বচ্ছ। রাসূলুল্লাহর (সা) দাওয়াত খুব দ্রুত তাঁকে প্রভাবিত করে। সীরাত লাখকদের মতে তাঁর পুর্বে মাত্র তের ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হলেন চৌদ্দতম মুসলমান। ইবন সা’দের একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা) আরকামের গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পুর্বেই, উসমান ইবন মাউজন, উবাইদা ইবনুল হারিস।আবদুর রহমান ইবন আউফ, আবু সালামা আবদিল আসাদ এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এক সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মদীনায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারী প্রথম মুহাজির এবং মদীনার বাকী গোরস্তানে দাফনকৃত প্রথম মুসলমান।
নবওয়াতের পঞ্চম বছরে সর্বপ্রথম মুসলমানদের একটি দল রাসূলুল্লাহর (সা) ইজাযত নিয়ে হাবশায় হিজরাত করেন। উসমান ইবন মাজউন ছিলেন এই মুহাজির দলটির আমীর বা নেতা। এই দলটির সাথে তাঁর পুত্র সায়িবও ছিলেন। বেশ কিছুকাল হাবশায় অবস্থানের পর সংবাদ পেলেন যে মক্কার গোটা কুরাইশ খান্দান ইসলাম কবুল করেছে।
তিনি আনন্দ সহকারে মক্কার দিকে যাত্রা করলেন। মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে যখন বুঝতে পারলেন খবরটি ভিত্তিহীন, তখন ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। কারণ এত দূর দেশে আবার ফিরে যাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি মক্কায় প্রবেশ করাও নিরাপদ নয়। আস্তে আস্তে যখন তাঁর সকল সঙ্গী-সাথী নিজ নিজ মুশরিক আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় মক্কায় ফিরে গেলেন, তখন তিনিও ওয়ালিদ ইবন মুগীরার নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশ করেন।
ওয়ালিদ ইবন মুগীরার প্রভাবে হযরত উসমান ইবন মাজউন দৈহিক অত্যাচার উৎপীড়নের হাত থেকে তো রেহাই পেলেন, কিন্তু রাসূল (সা) ও অন্যান্য সাহাবীদের ওপর যে যুলুম-অত্যাচার চলছিল ত দেখে মোটেই সুখী হতে পারলেন না। একদিন তিনি নিজেকে তিরস্কার করে বললেনঃ আফসুস! আমার আত্মীয়-বন্ধু ও গোত্রের লোকারা নানা রকম যুলিম-অত্যাচার সহ্য করছে আর আমি এক মুশরিকের সহায়তায় সুখে জীবন যাপন করছি। আল্লাহর কসম! এটা আমার নিজের সত্তার দারুণ দুর্বলতা।’
এমনই একটা চিন্তায় তিনি ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। একটা অপরাধ বোধে তিনি জর্জরিত হতে লাগলেন। তিনি ওয়ালিদের কাছে গিয়ে বললেনঃ ‘ওহে আবু আবদি শামস, তোমার দায়িত্ব তুমি যথাযথভাবে পালন করছো। এতদিন আমি তোমার আশ্রয়ে কাটিয়েছি, কিন্তু এখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হিফাজতে থাকাই আমি শ্রেয় মনে করি।
আমার জন্য আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাহাবীদের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট’। ওয়ালিদ বললোঃ ‘কেউ হয়তো তোমাকে কষ্ট দিয়েছে’। তিনি বললেন, না। আসল কথা, আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাহায্য এখন আমার প্রয়োজন নেই। তুমি এখনই আমার সাথে কা’বায় চলো এবং যেভাবে আমাকে আশ্রয় দানের কথা ঘোষণা করেছিলে তেমনিভাবে তা প্রত্যাহারের ঘোষণাটিও দিয়ে দাও’।
তার পীড়াপীড়িতে ওয়ালিদ কা’বার চত্বরে সাধারণ সমাবেশ ঘোষণা দান করলো এবং উসমানও দাঁড়িয়ে ওয়ালিদের কথা সত্যায়িত করে বললেঃ বন্ধুগন, আমি ওয়ালিদকে প্রতিশ্রুতি পালনকারী ও দয়াশীল পেয়েছি। যেহেতু এখন আমরা আল্লাহর ও তাঁর রাসূল ছাড়া আর কারো সহায়তা পছন্দীয় নয়, তাই আমি নিজেই ওয়ালীদের ইহসান বা উপকারের বোঝা আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলেছি’।
এই ঘোষণার পর উসমান ইবন মাজউন গেলেন লাবীদ ইবন রাবীয়ার সাথে কুরাইশদের একটি মজলিসে। লাবীদ ছিলেন তৎকালীন আরবের বিখ্যাত কবি। তিনি উপস্থিত হতেই কবিতার আসর শুরু হয়ে গেল। লাবীদ তাঁর কাসীদা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। যখন তিনি এ ছত্রে পৌঁছলেন-‘আলা কুল্লু শাইয়িন মা খালাল্লাহা বাতিলুন’-‘ওহে, আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই বাতিল-আসর’ তখন উসমান হঠাৎ বলে উঠলেন ‘তুমি সত্য কথাই বলেছো’।
কিন্তু লাবীদ যখন দ্বিতীয় ছত্রটি পাঠ করলেন-‘ওয়া কুল্লু নাঈমিন লামাহালাতা যায়িলুন’-এবং সকল সম্পদই নিশ্চিত ধ্বংস হবে –তখন তিনি প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠেন ‘তুমি মিথ্যা বলেছো’। মজলিসে উপস্থিত সকলেই ক্রোধভরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালো। তারা লাবীদকে শ্লোকটি পুনরায় আবৃত্তি করতে অনুরোধ করলো। লাবীদ আবার আবৃত্তি করলো এবং উসমানও প্রথম ছত্রটি সত্য ও দ্বিতীয়টি মিথ্যা বলে মত প্রকাশ করে বললেনঃ ‘তুমি মিথ্যা বলেছো।
জান্নাতের নিয়ামত বা সুখ-সম্পদ কখনও ধ্বংস হবে না। একথা শুনে লাবীদ একটু রুষ্ট হয়ে বললোঃ ‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা, তোমাদের মজলিসের এ অবস্থা তো পুর্বে কখনও ছিলনা।’ এই উস্কানিমুলক উক্তিতে সমগ্র মজলিস ক্রোধে ফেটে পড়লো। ইত্যবসরে এক হতভাগা উসমানের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর মুখে সজোরেনেক ঘুষি মেরে দেয়। ঘুষি খেয়ে তাঁর একটি চোখ রক্ত জমে কালো হয়ে যায়।
লোকেরা বললো, উসমান, তুমি ত ওয়ালিদের আশ্রয়ে বেশ ভালোই ছিলে এবং তোমার চোখও এ কষ্ট থেকে নিরাপদে ছিল’। জবাবে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর আশ্রয়ই সবচেয়ে বেশী নিরাপদ ও সম্মানজনক, আমার যে চোখটি এখনো ভালো আছে, সেটাও তার বন্ধুর কষ্টের ভাগো হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব।’ ওয়ালিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি আবার আমার হিফাজতে আসতে চাও?’ তিনি বললেন, ‘এখন আল্লাহর হিফাজতই যথেষ্ট।’ তাঁর এ সময়ের অনুভূতির চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর স্বরচিত একটি কাসীদায়। হযরত আলীও তাঁর একটি কবিতায় উসমানের এ ঘটনা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। (দ্রষ্টব্যঃ হায়াতুস সাহাবা, ১ম খন্ড)
এভাবে দীর্ঘদিন যাবত হযরত উসমান মক্কার নানা রকম অত্যাচার ও উৎপীড়ন ধৈর্য সহকারে সহ্য করতে থাকেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) সকল সাহাবীকে মদীনায় হিজরাতের অনুমতি দিলেন। হযরত উসমান ইবন মাজউন তার দুই ভাই কুদামা ইবন মাজউন, আবদুল্লাহ ইবন মাজউন ও পুত্র সায়িব ইবন উসমানসহ পরিবারের অন্য সকলকে নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। হযরত উসমান তাঁর খান্দানের একটি লোককেও মক্কায় রেখে যাননি। মদীনা পৌঁছে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবন সালামা আজলানীর (রা) অতিথি হন।
রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা পৌঁছে হযরত উসমান ও তাঁর ভাইদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এক খণ্ড প্রশস্ত ভূমি দান করেন এবং হযরত আবুল হাইসাম ইবন তাইহানের ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করে দেন।
সত্য ও মিথ্যার প্রথম সংঘাত ঘটে বদর প্রান্তরে। ইনি শরিক ছিলেন এ যুদ্ধে। যুদ্ধ থেকে ফেরার পরই তিনি রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর আনসারী ভাই এবং স্ত্রী পরিজনরা যথেষ্ট সেবা করেও
মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। হিজরতের তিরিশ মাস পরে হযরত উসমান ইবনে মাজউন মদীনায় ইনতিকাল করেন।
হযরত উম্মুল আলা আল আনসারিয়্যা- যার বাড়ীতে হযরত উসমান ইনতিকাল করেন, বলেনঃ গোসল ও কাফন দেওয়ার পর জানাযা তৈরী হলে রাসুল (সা) তাশরীফ আনলেন। আমি বলতে লাগলাম, ‘আবু সাইব, আল্লাহর রহমত তোমার উপর বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ তোমাকে সম্মানিত করবেন।
’ রাসুল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কিভাবে জানলে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন?’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, সে যদি না হয় তাহলে আর কাকে সম্মানিত করবেন?’ রাসুল (সা) বললেন, ‘উসমান ছিল দৃঢ় ঈমানের অধিকারী। তার ভালো হবে এমনটিই আমি আশা করি। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর রাসুল হয়েও জানিনে আমার কী পরিণাম হবে?’
হযরত উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যুতে রাসুল (সা) ভীষণ ব্যথিত হন। তিনি তিনবার ঝুঁকে পড়ে তার কপালে চুমু দেন। তখন রাসুলাল্লাহ (সা) চোখের পানিতে উসমানের গণ্ডদ্বয় সিক্ত হয়ে যায়। তারপ মাথা সোজা করে কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেনঃ আবু সাইব, আমি তোমার থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন! দুনিয়া থেকে তুমি এমনভাবে বিদায় নিলে যে, তার থেকে তুমি কিছু নিলে না এবং দুনিয়াও তোমার থেকে কিছুই নিতে পারেনি।’
হযরত উসমানের (রা) মৃত্যুর পরও রাসুল (সা) তাঁকে ভুলে যাননি। রাসুলাল্লাহর (সা) কন্যা হযরত রুকাইয়্যা মারা গেলে তিনি কন্যাকে সম্বোধন করে বলেন, ‘যাও আমাদের উত্তম অগ্রগামী উসমান ইবনে মাজউনের সাথে গিয়ে মিলিত হও।’
হযরত উসমান ইবনে মজউন যখন মারা যান তখন মদীনায় মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট কোন গোরস্থান ছিল না। উসমানের ওফাতের পর রাসুল (সা) মদীনার ‘বাকী’ নামক স্থানকে গোরস্থানের জন্য নির্বাচন করেন। রাসুল্লাল্লাহর (সা) সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই এখানে সমাহিত হন। রাসুল (সা) নিজেই জানাযার নামায পড়ান এবং কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দাফন কাজ তত্ত্বাবধান করেন। তারপর কবরের ওপর কোন একটি জিনিস চিহ্ন হিসেবে পুতে দিয়ে বলেন, ‘এখন কেউ মারা গেলে এর আশে পাশেই দাফন কড়া হবে।’
হযরত উসমানের চারিত্রিক মান অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের ছিল। জাহিলী যুগেই তিনি ছিলেন শরাবের প্রতি বিতৃষ্ণ। লজ্জা ছিল তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য।
রুহবানিয়্যাত বা বৈরাগ্যের প্রতি তাঁর গভীর ঝোঁক ছিল। একবার ইচ্ছা করলেন প্রবৃত্তির কামনা বাসনা ধ্বংস করে মরুচারী রাহিব বা সংসার-ত্যাগী হয়ে যাবেন। কিন্তু রাসুল (সা) জানতে পেয়ে তাঁকে এ উদ্দেশ্য থেকে বিরত রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমার জন্য সর্বোত্তম আদর্শ নই? আমি আমার স্ত্রীর সাথে মিলিত হই, গোশত খাই, রোযা রাখি এবং ইফতারও করি। রোযাই হলো আমার উম্মাতের খাসি বা নিবীর্য হওয়া। সুতরাং সে খাসি করবে বা খাসি হবে সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
ইবাদাত বা শবগোজারী ছিল তাঁর প্রিয়তম কাজ। সারা রাত তিনি নামায আদায় করতেন। বছরের অধিকাংশ দিনে রোযা রাখতেন। বাড়ীর একটা ঘর ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। রাত দিনে সেখানে ইতিকাফ করতেন। একদিন রসুল (সা) এই ঘরের চৌকাঠ ধরে দুই অথবা তিনবার বলেছিলেন, ‘উসমান, আল্লাহ্ আমাকে রুহবানিয়্যাত বা বৈরাগ্যের জন্য পাঠাননি। সহজ সরল দ্বীনে হানিফ সকল দ্বীন থেকে আল্লাহর প্রিয়তম।
ইবাদাতের প্রবল আগ্রহ স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি তাঁকে উদাসীন করে তোলে। একদিন তাঁর স্ত্রী নবী-গৃহে আসেন। নবীর (সা) সহধর্মিণী তার মলিন বেশ-ভূষা দেখে জিজ্ঞেস করেনঃ
‘তোমার এ অবস্থা কেন? তোমার স্বামী তো কুরাইশদের মধ্যে একজন ধনী ব্যাক্তি।’ জবাবে তিনি বললেনঃ তাঁর সাথে আমার কি সম্পর্ক। তিনি সারা রাত নামায পড়েন, দিনে রোযা রাখেন। ‘উম্মুল মুমিনীনগণ বিষয়টি আসূলুল্লাহর (সা) গোচরে আনেন। রাসূল (সা) তখনই উসমান ইবন মাজউনের বাড়ীর দিকে ছুটে যান এবং তাকে ডেকে বলেনঃ ‘উসমান, আমার নিজের জীবন কি তোমার জন্য আদর্শ নয়?’ উসমান বললেন, আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক’।
রাসূল্ম (সা) বললেন ‘তুমি সারা রাত ইবাদাত কর, অধিকাংশ দিন রোযা রাখ।’ বললেন হাঁ, এমনটি করে থাকি। ইরশাদ হলো, এরূপ করবেন না। তোমার ওপর তোমার চোখের, তোমার দেহের এবং তোমার পরিবার পরিজনের হক বা অধিকার আছে। নামায পড়, আরাম কর, রোযা ও রাখ এবং ইফতার কর।’ এই হিদায়াতের পর তাঁর স্ত্রী একদিন নবী গৃহে আসলেন। তখন কিন্তু তাঁকে নব বধুর সাজে সজ্জিত দেখাচ্ছিল। তাঁর শরীর থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছিল।
হযরত খাদীজার (রা) ইন্তিকালের পর হযরত উসমান ইবন মাজউনের স্ত্রী হযরত খাওলা বিনতু হাকীম, হযরত আয়িশা ও হযরত সাওদার সাথে বিয়ের প্রস্তাবটি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট পেশ করেছিলেন। তাঁরই মধ্যস্থতায় মূলতঃ রাসূলুল্লাহর (সা) এ দু’টি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা-২/৬৫৩)