বন্দী-শিবির থেকে – কবি শামসুর রাহমান
ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড়ো ঈর্ষা করি | তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্য নয় | ভালো খাওদাও
ফুর্তি করো সবান্ধব, সেজন্যেও নয় |
বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ |
যখন যা খুশি
মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই |
যখন যে-শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা |
সেসব কবিতাবলী যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মড়লেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো |
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ |
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ ফুল পাখি
এমন কি ‘নারী’ ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো |
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ ক’রে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই | শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে
রঙিন সাইনবোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানি নি আগে | উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলা দেশ—- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখছে সর্বদা |
অথচ জানে না ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু-চোখে
পথের ধুলোয়,
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি |
আরও পড়ুন
-
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা – কবি শামসুর রাহমান
-
আসাদের শার্ট – শামসুর রাহমান
-
তুমি বলেছিলে – শামসুর রাহমান
-
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ? – শামসুর রাহমান
-
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা – কবি শামসুর রাহমান